কুরবানী
কুরবানী ফযিলতঃ
কুরবানী দিনগুলোর মাঝে কুরবানী করাই আল্লাহ তায়ালার নিকট সবচেয়ে পছন্দনীয় আমল। এ ব্যাপারে আম্মাজান হযরত আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, কুরবানী দিনগুলোর মাঝে কুরবানী পশুর রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে অধিক পছন্দনীয় অন্য কোন আমল নেই। আর এই কুরবানী পশু কিয়ামতের দিন তার শিং, পশম, ও খুরসহ মিজানের পাল্লায় উপস্থিত হবে। এবং কুরবানী পশুর রক্ত জমিনে পড়ার পূর্বেই তা আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে থাকে। সুতরাং তোমরা সানন্দে কুরবানী করো। (সুনানে তিরমিযি-৩১২৬, সুনানে ইবনে মাজাহ-১৪৯৩, তারগীব-২৫৫)
এ ছাড়াও কুরবানী পশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে সওয়াব রয়েছে। হযরত যায়েদ বিন আরকাম রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবাগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এ সকল কুরবানী ফযিলত কী? উত্তরে তিনি বললেন, তোমাদের পিতা ইবরাহীম আ. এর সুন্নাত। তারা পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন, তাতে আমাদের জন্য কী সওয়াব রয়েছে? তিনি বললেন, এর প্রতিটি চুলের বিনিময়ে একটি করে সওয়াব রয়েছে। তারা আবারো প্রশ্ন বরলেন, হে রাসূলুল্লাহ! লোমশ পশুর হুকুম কী? (এটাতো গণনা করা সম্ভব) তিনি বললেন,এরও প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে সওয়াব রয়েছে। (সুনানে ইবনে মাজাহ-২২৬ পৃ.)
কুরবানী ছেড়ে দেয়ার ক্ষতি:
সমার্থ থাকা সত্বেও কুরবানী না করা আল্লাহর নেয়ামতের অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ পায়। গোনাহগার হবার পাশাপাশি,মহত সওয়াব থেকে বঞ্চিত হতে হয়। এজন্য এ ব্যপারে আল্লাহর রাসূল কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন।
হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত রাসূল সা. বলেন, যে ব্যক্তি সক্ষমতা থাকা সত্বেও কুরবানী করলো না। সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটে না আসে। (সুনানে ইবনে মাজাহ-২২৬)
কুরবানী বিধান:
যদি কারো কাছে জিলহজ্ব মাসের ১০,১১, ও ১২ তারিখের যে কোন দিন নিজ প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমান (সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা বা এর সমমূল্যের) সম্পদ থাকে তাহলে তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। (ফাতওয়া শামী ৯/৪৫৩)
কুরবানী দিনে কুরবানী না করে এর টাকা সদকা করে দিলে তার উপর থেকে কুরবানী বিধান রহিত হবেনা। (ফাতওয়া আলমগিরী – ৫/২৯৩,)
কুরবানী পশু ও তার বয়স:
তিন শ্রেনীর পশু দ্বারা কুরবানী করা যায়,
১. ছাগল, ভেড়া, দুম্বা (কমপক্ষে এক বছর হওয়া জরুরি)
২. উট (কমপক্ষে পাঁচ বছর হওয়া জরুরী)
৩. গরু, ও মহিষ। (কমপক্ষে দুই বছর হওয়ার জরুরী)
ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, মাঝে শরিকানা জায়েয নেই বরং একটি পশু দ্বারা একজনের কুরবানী করতে হবে। আর পরবর্তী দুই শ্রেণীর মাঝে সাতটি পর্যন্ত অংশে কুরবানী করা যাবে।
শরীকানা কুরবানীঃ
শরীকানা কুরবানী ক্ষেত্রে দুটি বিষয় লক্ষণীয়১. শরীকদের প্রত্যেকেই যেন পশু জবাইয়ের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য ও সওয়াব হাসিলের নিয়ত করে। কেউ যদি গোস্ত খাওয়া বা অন্য কোন উদ্দেশ্যে কুরবানী করে তাহলে কারো কুরবানীই কবুল হবে না। তাই সবার নিয়ত যাচাই করে নেয়া উচিত। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া-৫/৩৫১) ২. কোন শরীক যদিপুরো বা অধিকাংশ হারাম উপায়ে অর্জিত সম্পদ দ্বারা কুরবানীতে অংশ গ্রহণ করে,তাহলেও কারো কুরবানী সহীহ হবে না।তাই জেনে শুনে হারাম অর্জনকারীকে শরীকানায় নেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক হওয়া উচিত।
- কুরবানীর গরু, মহিষ ও উটে আকীকার নিয়তে শরীক হতে পারবে। এতে কুরবানী ও আকীকা দুটোই সহীহ হবে। (ফাতাওয়া শামী,-৯/৪৭২, হিন্দিয়া,-৫/৩০৪)
কুরবানী গোস্তঃ
কুরবানী গোস্তের ক্ষেত্রে মুস্তাহাব হলো,তিনভাগে ভাগ করে এক অংশ ফকীর মিসকীনকে দান করা। আরেক অংশ আত্মীয় সজন ও বন্ধুবান্ধবদের দেওয়া। আর তৃতীয় অংশ নিজের পরিবার নিয়ে খাওয়া। তবে কেউ যদি পুরোটাই নিজের কাছে রেখে দেয় তাতেও কোন সমস্যা নেই। (ফাতাওয়া শামী,-৯/৪৭৪, তাতারখানিয়া,-১৭/৪৩৭)
শরীকানায় কুরবানী দিলে প্রত্যেক শরীককে তার অংশ মেপে সমানভাগে ভাগ করে দিতে হবে। অনুমানের ভিত্তিতে বণ্টন করলে,এই বণ্টন সহীহ হবে না। (ফাতাওয়া শামী,-৯/৪৬০, তাতারখানিয়া, ১৭/৪৫৫, হিন্দিয়া,-৫/৩০৬)
- কুরবানী পশুর গোস্ত,চামড়া ইত্যাদি কাজের বিনিময় হিসেবে দেয়া যাবে না। (ফাতাওয়া শামী,-৯/৪৭৫, তাতারখানিয়া,-১৭/৪৪২)
- মান্নত বা অসীয়তের কুরবানী পশুর গোস্ত পুরোটাই ফকীর মিসকীনকে দিয়ে দিতে হবে। (ফাতাওয়া শামী,-৯/৪৬০, তাতারখানিয়া,-১৭/ ৪১৫)
কুরবানী পশুর চামড়াঃ
কুরবানী পশুর চামড়া দান করে দেয়া মুস্তাহাব। তবে যদি বিক্রি করে,তাহলে বিক্রির টাকা পুরোটাই সদকা করে দেয়া আবশ্যক। (ফাতাওয়া শামী,-৯/৪৭৫)
- কুরবানী পশুর চামড়া দীনি মাদরাসার গরীব ছাত্রদের প্রতি দান করে দিলে তিনটি ফায়দা আছে।১. সদকা করার সওয়াব হবে। ২. ইলমে দীনের প্রচার হবে। ৩. সদকায়ে জারীয়ার সওয়াব হবে।
কুরবানী পরবর্তী কাজঃ
নিজের কোন কাজ বা আমল করার ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশনা হলো,এমনভাবে করতে হবে যাতে এর দ্বারা অন্য কারো কষ্ট না হয়। বরং ইসলামে কষ্টদায়ক বস্তুকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিয়ে হলেও পরোপকারের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ঈমানের অনেক শাখা রয়েছে। তার মাঝে নিম্নতরশাখা হলো, কষ্টদায়ক বস্তুকে রাস্তা থেকে সরিয়ে ফেলা। উক্ত নসিহতের আলোকে কুরবানীদাতাকে অবশ্যই এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে যে, কুরবানী পশুর রক্ত, রশি, হাড্ডি, ভূঁড়ি ইত্যাদি উচ্ছিষ্ট বস্তু যেন কুরবানীস্থল বা রাস্তায় না পড়ে থাকে। তাকে নিজ দায়িত্বে তা যথাস্থানে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথায় দুর্গন্ধ মহল্লার মানুষদের কষ্ট দিবে। সুতরাং কুরবানীদাতার জন্য কুরবানী পরবর্তী কিছু কাজ করতে হবে–১. কুরবানী পশু জবাইয়ের পর বেশী পরিমানে পানি ঢেলে রক্তের চিহ্ণ দূর করে ফেলতে হবে। ২. উচ্ছিষ্ট বস্তু (হাড়, রশি, হুগলা ইত্যাদি) জনসমাগম থেকে দূরে (ডাস্টবিনে) ফেলার ব্যবস্থা করা। ৩. দুর্গন্ধ ও জীবাণু দূর করতে ব্লিচিং পাউডার, সেভলন ইত্যাদি ব্যবজার করা।