নামাজ অবস্থায় টাকনুর নিচে কাপড় থাকলে বা কাপড় পড়ে গেলে ওজু ভেঙ্গে যায় কি না?
আমার
নামঃ নাজমুল কবীর
ঠিকানাঃ ময়মনসিংহ।
আস্ সালামু আলাইকুম।
শ্রদ্ধেয়
মুফতি সাহেব,
কিছুদিন আগে এক গাইরে মুকাল্লিদী ভাই আবু দাউদ শরীফের একটি হাদীস দেখিয়ে বলল, নামাজ অবস্থায় টাকনুর নিচে কাপড় থাকলে বা কাপড় পড়ে গেলে ওজু চলে যায়। হাদীসটি হলো- প্রথম খণ্ড, হাদীস নং- ৬৩৬, অনুবাদ – ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
দয়া করে বুঝিয়ে বলবেন (যাতে ভুল হলে তাকে সংশোধন করা যায়), এটি অজু ভাঙার কারণ কিনা?
بسم الله الرحمن الرحيم
. وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
উত্তরঃ নামজে টাখনুর নিচে কাপড় থাকলে অজু ভেঙ্গে যাওয়ার দলিল হিসেবে যে হাদীসটি আনা হয়েছে,চলুন আমরা প্রথমে সেই হাদীসটি দেখি; রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এব্যপারে কি বলেছেন,
হাদীসের প্রথমাংশে একটি ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে, যেখানে এক সাহাবী টাখনুর নিচে পাজামা ঝুলিয়ে নামাজ পরছিলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেনঃ যাও অজু করে আস। তিনি অজু করে আসলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে পুনরায় অজু করে আসার নির্দেশ দিলেন।ঐ সাহাবী আবার অজু করে আসলেন।
এখানে একটি বিষয় লক্ষ করুন, প্রথমবার যখন ঐ সাহাবীকে অজু করে আসার নির্দেশ দিলেন, তখন তিনি নামাজ পড়ছিলেন। কিন্তু দ্বিতীবার যখন নির্দেশ দেয়া হল, তখন কিন্তু তিনি নামাজে পড়ছিলেন না (হাদীস দ্বারা তাই বুঝা যাচ্ছে)।ঐ আহলে হাদিস ভাইয়ের বক্তব্য আনুযায়ী প্রথমবার অজু করে আসার নির্দেশ দেয়ার কারণ তো বুঝলাম, তিনি নামাজে টাখনুর নিচে কাপড় ঝুলিয়ে রেখেছিলেন, তাই তার অজু চলে গিয়েছিল এজন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে অজু করতে বলেছেন। কিন্তু দ্বিতীয়বার কেন তাকে আবার অজু করতে বললেন? তিনি তো তখন নামাজ পড়ছিলেন না। তাহলে তো বুঝা যাচ্ছে টাখনুর নিচে কাপড় ঝুলিয়ে রাখলেই অজু চলে যায়, তা নামাজে হোক বা বাহিরে। আর বিষয়টা যদি এমনই হয়, তাহলে আপনার “আহলে হাদীস(?)” ভাই “নামাজ অবস্থায়” এই বিশেষ শর্তটি কোন হাদীসে পেলেন?
এখন অজুর আদেশ দেয়ার প্রকৃত কারণ কী? তা উপস্থিত সাহাবার (রাযিয়াল্লাহু তাআলা আনহুম) প্রশ্নের জবাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই বলেছেন, চলুন আমরা এখন পরের আংশ দেখি,হাদীসে কি এসেছে,
উপস্থিত এক সাহবী জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল আপনি কেন তাকে অজু করার নির্দেশ দিলেন,তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,ঐ ব্যক্তি কাপড় ঝুলিয়ে নামাজ পড়ছিল এবং আল্লাহ তায়ালা এরূপ ব্যক্তির নামাজ আদৌ কবুল করেন না। দেখুন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিন্তু বলেননি তার অজু চলে গেছে; তাই তাকে অজু করতে বলেছি।
এখানে লক্ষণীয়,নামাজ পড়া অবস্থায় ও না্মাজের বাহিরে উভয় ক্ষেত্রের আদেশের কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএকটিই বলেছেন, ভিন্ন করেননি। তাই বুঝা গেল উভয় অবস্থার আদেশের কারণ এক।
চলুন, এখন দেখি মুহাদ্দীস গন এর ব্যাখ্যায় আর কি বলেছেন, মেশকাত শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ মিরকাতুল মাফাতীহ এ মুল্লা আলী কারী র. বলেন,
وإطالة الذيل مكروهة عند أبي حنيفة والشافعي في الصلاة وغيرها ومالك يجوزها في الصلاة دون المشي لظهور الخيلاء فيه قال له رسول الله أي بعد صلاته لكون صلاته صحيحة فأراد أن يبين له أنها غير مقبولة فقال اذهب فتوضأ
ইমাম আবু হানীফা ও শাফী র. এর নিকট নামাজে ও নামাজের বাইরে কাপড়ের পাড় ঝুলিয়ে রাখা মাকরূহে তাহরীমী (অজু ভাঙ্গার কারণ নয়)।…………… রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে নামাজের পর একথা (যাও অজু করে আস) বলার অর্থ হল এটা বুঝানো যে, তার নামাজ শুদ্ধ হয়ে গেছে কিন্তু তা কবুল হয়নি।
আল্লামা তীবী র. এও ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেন,
قيل لعل السر في أمره بالتوضؤ وهو طاهر أن يتفكر الرجل في سبب ذلك الأمر فيقف على ما ارتكبه من المكروه وأن الله ببركة أمر رسوله عليه السلام إياه بطهارة الظاهر يطهر باطنه من دنس الكبر لأن طهارة الظاهر مؤثرة في طهارة الباطن
কেউ কেউ বলেন, ঐ ব্যক্তি পবিত্র থাকা সত্তেও তাকে অজু করতে আদেশ দেয়ার গুপ্তভেদ সম্ভবত এই যে, তাকে এই আদেশ করার কারণ সম্পর্কে তিনি চিন্তা-গবেষণা করবেন।তারপর তিনি যেই অশভোনীয় কাজে লিপ্ত ছিলেন তা হতে বিরত হবেন।আর আল্লাহ তাআলা নিশ্চয়ই তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামর আদেশের বরকতে তার বাহ্যিক দিক পবিত্র করে দেয়ার সাথে সাথে আভ্যন্তরীণ অহংকারের কদর্যতা থেকেও পবিত্র করে দিবেন।কেননা বাহ্যিক পবিত্রতা আভ্যন্তরীণ পবিত্রতাকে প্রভাবিত করে।
একথার স্বপক্ষে হাদীসে প্রমাণ পাওয়া যায়,
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَا مِنْ مُسْلِمٍ يُذْنِبُ ذَنْبًا ثُمَّ يَتَوَضَّأُ فَيُصَلِّي رَكْعَتَيْنِ ثُمَّ يَسْتَغْفِرُ اللَّهَ تَعَالَى لِذَلِكَ الذَّنْبِ إِلَّا غفَرَ لَهُ
আল্লাহর রাসূল বলেনঃ যখন কোন মুসলিম কোন গুনাহ করার পর অজু করে দু’রাকাত নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে ইস্তেগফার করে তখন আল্লাহ তার গুনাহকে ক্ষমা করে দেন। (মুসনাদে আহমদ ৪৭)
فذهب وتوضأ ثم جاء فكأنه جاء غير مسبل إزاره فقال رجل يا رسول الله مالك أمرته أن يتوضأ أي والحال أنه طاهر قال إنه كان يصلي وهو مسبل إزاره وإن الله لا يقبل أي قبولا كاملا صلاة رجلمسبل إزاره ظاهر جوابه عليه السلام أنه إنما أعاده بالوضوء والله أعلم إنه لما كان يصلي وما تعلق القبول الكامل بصلاته والطهارة من شرائط الصلاة وأجزائها الخارجةفسرى عدم القبول إلى الطهارة أيضا فأمره بإعادة الطهارة حثا على الأكمل والأفضل فقوله يصلي أي يريد الصلاة فالأمر بالوضوء قبل الصلاة
তিনি গেলেন ও অজু করে আসলেন, হয়ত যখন আসলেন তখন কাপড় ঝুলানো অবস্থায় ছিলেন না। তাই এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! “আপনি কেন তাকে অজু করতে নির্দেশ দিলেন?” অথচ সে তো পবিত্র অবস্থায় আছে।রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সে কাপড় ঝুলানো অবস্থায় নামাজ পড়ছিল। অথচ আল্লাহ তাআলা এরূপ ব্যক্তির নামাজ পরিপূর্ণ রূপে কবুল করেন না।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামর জওয়াব থেকে বাহ্যিক ভাবে এটা বুঝা যাচ্ছে,তিনি অজু পুনরায় করিয়েছেন —আল্লাহ তায়ালাই অধিক জ্ঞাত—সে যখন নামাজ পড়ছিল তখন তার নামাজের সাথে পরিপূর্ন কবুলিয়াতের সম্পৃক্ততা ছিলনা।আর তহারাত তো নামাজের পূর্ব শর্ত, বাহিরের বিষয় (অজু না থাকলে নামাজ শুরু করাই শুদ্ধ হবেনা,কবুলিয়াত তো পরের বিষয়) কবুল নাহওয়াটা তহারাতেও সংক্রমিত হয়েছে। তাকে পুনরায় তহারাত অর্জনের আদেশ দেয়া হয়েছিল এরচেয়ে আরোপূর্ণ, আরো উত্তম কর্মের প্রতি অনুপ্রাণিত করার জন্য। আর হাদীসে নামাজ পড়ছিল বলতে বুঝানো হয়েছেঃ নামাজ পড়ার ইচ্ছা করছিল সতরাং অজুর নির্দেশটি ছিল নামাজ শুরু করার পূর্বের।
وأما ما ذكره ابن حجر من أن ظاهر الحديث أنه أمر المسبل بقطع صلاته ثم بالوضوء فهو غير صحيح لقوله تعالى لا تبطلوا أعمالكم
ইবনে হাজার আসকালানী র.এর ব্যাখ্যায় যা বলেনঃ হাদীসের বাহ্যিক অর্থ যেটা বুঝা যাচ্ছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাপড় ঝুলিয়ে নামাজ আদায়কারীকে নামাজ ছেড়ে দিয়ে অজু করার আদেশ দিয়েছেন।অথচ এটা সহীহ না কেননা আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ তোমরা তোমাদের আমলসমূহকে নষ্ট করনা।(মিরকাতুল মাফাতীহ ২/৪৩৫-৪৩৬)
দেখেছেন হাদীসের ব্যাখ্যায় একথা কেউ বলেননি অজু ভাঙ্গে যাওয়ায় তাকে অজু করার নির্দেশ দিয়েছেন।কোন সাহাবী তাবেঈ থেকেও এরূপ কোন বক্তব্য পাওয়া যায়না। সুতরাং এক্ষেত্রে অজু চলে যাওয়ার বক্তব্যটি ইসলামের মাঝে সম্পূর্ণ নতুন এক আমদানী। যা সরাসরি হাদীস অনুসরনের নামে অজ্ঞতা থেকে সৃষ্ট ।
قال رسول الله صلى الله عليه و سلم : من أحدث في أمرنا هذا ما ليس فيه فهو رد
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ যে দ্বীনের ব্যপারে নতুন কিছু উদ্ভব করে অথচ সেরকম কিছু দ্বীনের মাঝে নেই। তো সেটা প্রত্যাক্ষিত হবে।(সহীহ বুখারী২৫৫০ ,সহীহ মুসলিম১৭১৮)
এছাড়া গাইরে মুকাল্লিদদের অনুসরণীয় বরণীয় মুহাদ্দিস, যার সত্যায়ন ছাড়া কোন হাদীসকে তারা হাদীস মনে করেনা। সেই শায়খ আলবানী তো এই হাদীসকে যয়ীফ (দুর্বল) বলেছেন।(দেখুন আল্বানীর তাহকীক কৃত সহীহ ও যয়ীফ সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং৬৩৮) যারা সহীহ হাদীস সহীহ হাদীস বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলে, সহীহ হাদীসের অনুসরণ করেনা বলে অন্যদের দোষারোপ করে তারা কেন যয়িফ হাদীস দিয়ে ভুল দলীল দিচ্ছেন? তাদের উদ্দেশ্য কী? হাদীসের অনুসরন না মসলিমদের বিভ্রান্ত করা? আল্লাহ তাআলাই ভাল জানেন।
আল্লাহ তায়ালা অবুঝদের হেদায়াত দান করুক। আমীন।
والله اعلم بالصواب
উত্তর প্রদানে
মাওলানা মুহাম্মাদ আরমান সাদিক
ইফতা বিভাগ
জামিয়াতুল আসআদ আল ইসলামিয়া
সত্যায়ন ও সার্বিক তত্তাবধানে
মুফতী হাফীজুদ্দীন দা. বা.
প্রধান মুফতী
জামিয়াতুল আসআদ আল ইসলামিয়া