তাবলীগ ও আত্মশুদ্ধি বিষয়ক
আবু জারির
ঢাকা, বাংলাদেশ
আসসালামু আলাইকুম।
আমি একজন সাধারণ শিক্ষিত মুসলমান। আল্লাহর রহমতে তাবলীগ জামাতে ৩ চিল্লা সময় দিয়েছি। আমার প্রশ্ন হল আত্মশুদ্ধির জন্য অর্থাৎ কুদৃষ্টি, হিংসা, অহংকার, গীবত, রিয়া ইত্যাদি দোষ থেকে বাঁচা এবং তাকওয়া, ইখলাস, বিনয়, শোকর ইত্যাদি গুণ অর্জনের জন্য আমার কি করনীয়?
মসজিদওয়ার ৫ কাজ করা ও বছরে নেসাবি চিল্লা দেওয়াই যথেষ্ট নাকি এর সাথেসাথে কোন হক্কানি শায়েখের কাছে বায়াত হওয়া বা এসলাহী সম্পর্ক স্থাপন করার কোন প্রয়োজন আছে। বিস্তারিত দলীল সহ জানিয়ে বাধিত করবেন। জাঝাকাল্লাহ খায়ের।
بسم الله الرحمن الرحيم
وعليك السلام و رحمة الله و بركاته
উত্তরঃ হজরতজী মাওলানা ইলিয়াস র. জারীকৃত দাওয়াত ও তাবলীগ মানুষকে আল্লাহ তায়ালার দিকে ধাবিত করে, ঈমানকে তাজাকরে, আমলের দিকে ধাবিত করে এছাড়াও আরো ভাল কাজের প্রতি জজবা তৈরী করে থাকে।তবে এর অর্থ এই নয় যে তাবলীগের মেহনত করলে দ্বীনের অন্য কোন মেহনত করতে হবেনা , বরং যাদের ক্বেরাত সহীহ নয় তারা ক্বারী সাহেবের কাছে যেয়ে কুরআন সহীহ করে নিবে। মাসয়ালা মাসায়েল জানার জন্য মুফতী ও অভিজ্ঞ আলেমের শরণাপন্য হবে। নফসের আত্মশুদ্ধির জন্য হক্বানী পীর মাশায়েখের সন্যিধ্যে থাকবে। তাহলে তার দ্বীনদারী পূর্ণ হবে।তালীম, তাযকিয়া, তাবলীগ, জিহাদ,আখলাক এগুলো সবই দ্বীনের ভিন্ন ভিন্ন অংশ। দ্বীনদারী পূর্ণ করার জন্য প্রত্যেকটির মেহনত জরুরী। কোন একটা করার দ্বারা অপরটা আদায় হবেনা। তাই একটাকেই যথেষ্ট মনে করে অন্যগুলোকে ছেড়ে দেয়া বা গুরুত্বহীন মনে করা উচিৎ নয়।
আল্লাহ তাআলা মানুষের মাঝে হিংসা,অহংকার,ক্রোধ ইত্যাদি খারাপ গুণাবলি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এগুলার খারাবী থেকে বাচার পথও বাতলে দিয়েছেন।নফসের তাযকিয়ার মাধ্যমে এগুলো থেকে বেচে থাকা সম্ভব।আর তাযকিয়ায়ে নফসের জন্য সেই পথই তো সবচেয়ে উত্তম ও কার্যকরী যে পথে আমাদের আকাবিররা চলেছেন।
اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ (6) صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ*
আমদের সহজ সরল পথ দেখান। তাদের পথ যাদের প্রতি নিয়ামত দান করেছেন।
বর্তমান তবলীগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা হযরতজী মাওলানা ইলিয়াছ র.হযরত মুফতী রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী র. এর খানকাহে থেকে নিজ আত্মার এসলাহ করিয়েছেন।হযরতের ইন্তিকালের পর শাইখুল হাদীস খলীল আহমদ সাহারানপুরী র. এর বায়াত হন এবং পরবর্তীতে তাঁর খেলাফত প্রাপ্ত হন। এছাড়াও তাঁর যে কয়েকজন মুরুব্বী ছিলেন,হযরত গাঙ্গুহী র., হযরত থানবী র.,হযরত খলীল আহমদ সাহারানপুরী র. তাঁরা সকলেই নিজ শাইখের দরবারে থেকে নিজেদের আত্মার এসলাহ করিয়েছেন।
শাইখুল হাদীস মাওলানা যাকারিয়া র. তিনিও শাইখুল হাদীস খলীল আহমদ সাহারানপুরী র. এর খানকায় থেকে রিয়াজত -মজাহাদা করে নিজের আত্মার পরিশুদ্ধি করিয়েছেন ও পরবর্তীতে তাঁর খেলাফত লাভ করেন। বাংলাদেশের তাবলীগ জামাতের সর্বপ্রথম আমীর, হযরত মাওলানা আব্দুল আযীয র. তিনিও নিজেকে শাইখ যাকারিয়া র.এর সান্যিধ্যে নিজেকে সোপর্দ করে তাযকিয়ায়ে নফস করেছেন। তিনি শাইখ যাকারিয়া র. এর খলীফাও ছিলেন। যদি মসজিদওয়ার ৫ কাজ করা ও বছরে নেসাবি চিল্লা দেওয়াই আত্মার পরিশুদ্ধির জন্য যথেষ্ট হয়ে যেত; তাহলে উপরোল্লিখিত বড় বড় মুরুব্বীগণের আত্মার পরিশুদ্ধির জন্য হক্কানি শায়েখের কাছে বায়াত হওয়া বা এসলাহী সম্পর্ক স্থাপন করার কোন প্রয়োজন হত না।
হক্কানি কোন শায়েখের কাছে বায়াত হওয়া ও এসলাহী সম্পর্ক স্থাপন করার ব্যপারে তবলীগ জামাতের নেসাবী কিতাব ফাযায়েলে আমলেও বিভিন্ন যায়গায় গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ফাজায়েলে তবলীগের ৩৩ নং পৃষ্ঠায় শায়েখ যাকারিয়া র. লিখেছেন, “জাহেরী ইলমের সাথে সাথে বাতেনী এলেম হাসীল করিতে হইবে…………এইজন্য মুবাল্লিগ ভাইদের খেদমতে আমার আরজ তাহারা যেন সর্বপ্রথম নিজেদের জাহেরী ও বাতেনী ইসলাহের ফিকির করেন।তাহা না হইলে, খোদা না করুন এই সমস্ত ভয়াবহ শাস্তির আওতায় পড়িয়া যাইতে হবে”।
ফাযায়েলে তবলীগের সপ্তম পরিচ্ছেদে তো এর পরিশিষ্ট ও সম্পুরক হিসেবে বিশদ ভাবে আলোচনা করেছেন,(কিছু অংশ উল্লেখ করা হল) তিনি লিখেন, ইহা ষষ্ঠ পরিচ্ছেদের পরিশিষ্ট ও সম্পুরক। পাঠক বৃন্দের খেদমতে একটি জরুরী আরজ হইল এইযে, আল্লাহওয়ালাদের সাথে অধিক সম্পর্ক রাখা এবং তাদের খেদমতে বেশী বেশী হাজির হওয়া।যা দ্বীনের কাজে শক্তি বৃদ্ধি ও খায়ের-বরকতের কারণ। ……………………………
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ (سورة التوبة-119)
হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ তা’আলাকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক।(সূরা তাওবা-১১৯)
মুফাস্সির গণ লিখিয়াছেন সত্যবাদীদের দ্বারা এখনে সূফী মাশায়েখগণকে বুঝানো হয়ইয়াছে। যখন কোন ব্যক্তি তাহাদের খাদেম হইয়া যায় তখন তাহাদের তরবিয়ত ও বুযূর্গীর বদৌলতে সে উন্নতির উচ্চ শিখরে পৌঁছায়া যায়। শায়খে আকবর রহ. লিখিয়াছেন, যদি তোমর কাজ-কর্ম অপরের ইচ্ছার অধীন না হয়, তবে তুমি সারাজীবন সাধনা করিয়াও মনের খাহেশাত হইতে ফিরিতে পারিবেনা। অতএব,যখনই তুমি এমন ব্যক্তি পাইয়া যাও যাহার প্রতি তোমার অন্তরে ভক্তি-শ্রদ্ধাহয়। তখনই তাহার খেদমতে লাগিয়া যাও। তাহার সম্মুখে তুমি মুর্দার মত হইয়া থাক যাহাতে তিনি তোমার ব্যপারে যাহা ইচ্ছা তাহাই করিতে পারেন। এবং তোমার ইচ্ছা বলিতে যেন কিছুই অবশিষ্ট না থাকে। তাহার হুকুম পালনে জলদি কর। তিনি যে জিনিষ হইতে নিষেধ করেন উহা হইতে বিরত থাক।।…….অতএব ইহা অত্যান্ত জরুরী যে, কামেল শায়েখ তালাশ করিতে তুমি সচেষ্ট হও। তাহা হইলেই তিনি তোমাকে আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌছাইয়া দিবেন।(পৃষ্ঠা-৫২-৫৫)
এছাড়াও ফাযায়েলে আমলের বিভিন্ন স্থানে বুজুর্গানে দ্বীনের সান্যিধ্য লাভ করার কথা বলা হয়েছে।
আমরা দাওয়াতি মেহনত করি কিন্তু যাদের মেহনতের কাছে আমাদের কাজ কিছুইনা সেই সাহাবা রাযিয়াল্লাহু তাআলা আনহুম আজমাঈন ইসলামের শত খেদমত আঞ্জাম দেয়া সত্বেও তাদের শ্রেষ্টত্বের একমাত্র কারণ হল বিশ্ব নবী সা. এর সোহবত। নবীজীর সোহবত যিনি যত বেশি ইখতিয়ার করেছেন তিনি তত বেশী চমকিয়েছেন।
মাশায়েখে কিরাম লিখেছেন, মানুষের শরীরের যেমন রোগ-ব্যাধি রয়েছে তেমন আত্মারও রোগ-ব্যাধি রয়েছে। শারিরিক ভাবে সুস্থ থাকতে যেমন ডাক্তারের কাছে যেয়ে চিকিৎসা করাতে হয়, তেমন অন্তরের রোগ থেকে মুক্ত হতে চাইলেও ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। অন্তরের রোগের ডাক্তার হলেন হক্বানী পীর-মাশায়েখগণ। তাঁরা আত্মিক পরিশুদ্ধি বা ইসলাহে নফস করতে সহযোগিতা করেন।যা প্রত্যেকের জন্য ফরজ। আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا) سورة التحريم-6)
হে মুনিনগণ তোমরা নিজেদের ও পরিবার পরজনকে জাহান্নাম হতে রক্ষা কর।(সূরা তাহরীম-৬)
হিংসা,অহংকার,রিয়া ইত্যাদি খারাপগুণ থেকে না বাচতে পারলে নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করা যাবেনা।আর এসব খারাপগুণ থেকে বাচার জন্য হক্বানী পীর মাশায়েখদের সহবত গ্রহণ করে অন্তরের চিকিৎসা করা একান্ত জরুরী।
والله اعلم بالصواب
উত্তর প্রদানে
মাওলানা মুহাম্মাদ আরমান সাদিক
ইফতা বিভাগ
জামিয়াতুল আসআদ আল ইসলামিয়া
সার্বিক তত্তাবধানে
মুফতী হাফীজুদ্দীন দা. বা.
প্রধান মুফতী
জামিয়াতুল আসআদ আল ইসলামিয়া
ইমেইল-jamiatulasad@gmail.com