শান্তির ধর্ম ইসলাম
ইসলাম শব্দের আরবি মূল ‘সিলমুন’যার অর্থ শান্তি। আর ইসলাম অর্থ আত্মসমর্পণ করা। যেহেতু মহান পরাক্রমশালী আল্লাহ তাআলার দরবারে আত্মসমর্পণ করার দ্বারা মানুষ তার প্রবৃত্তির শৃঙ্খলমুক্ত হয়ে পরস্পর সহানুভূতি ও শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। এ জন্যই ইসলামকে শান্তির ধর্ম বলা হয়। ইসলামের নবীগণের দাওয়াতও ছিলো,শান্তির পয়গাম। প্রত্যেক কওম বা জনপদবাসী যখন প্রবৃত্তির তাড়নায় মানবতার শেষ চিহ্নটুকু হারিয়ে হিংস্র পশুর চরিত্রে রুপান্তর হয়েছিল,তখনই এই বর্বরতা নির্মূলের জন্য নবীগণ আগমণ করতেন।
তারা মানুষকে ডাকতেন আল্লাহর দিকে। আহ্বান করতেন,হে মানবজাতি! তোমরা বলো,”লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” আল্লাহ ছাড়া গোলামীর উপযুক্ত আর কেউ নেই। তবে তোমরা এই নিকৃষ্টতা থেকে উঠে সফলতা লাভ করবে ।
ছোট্ট একটি বাক্য । মানুষের প্রবৃত্তির গোলামি ছেড়ে মহান সৃষ্টিকর্তার গোলামি কর। সমাজে ভারসাম্য ফির আসবে। কারণ মানুষ যদি প্রবৃত্তির অনুসরণ করে,তবে প্রত্যেকের প্রবৃত্তি স্বভাবতই এক রকম হবে না। ভিন্ন হবে। আর এতে শুরু হবে বিশৃঙ্খলা। অথবা প্রত্যকেও একজনকে মানতে পারবে না কারণ সবাই একজন মানুষের ব্যপারে একমত হতে পারবে না। এখন যাদের ব্যাপারে একমত হবে তারা যদি আবার ইচ্ছামত পরিচালনা করে তাহলে পরিচালক শ্রেণীর মধ্যেও শুরু হবে পরস্পর দ্বন্দ্ব,বিদ্বেষ ও শত্রুতা এবং এক পর্যায়ে বেধে যাবে লড়াই – যুদ্ধ । এসবের একমাত্র সমাধান হল মানুষ তার বিষয়কে মহান সৃষ্টিকর্তার হাতে অর্পণ করবে । এখানে সবার একমত হওয়া সম্ভব। ফলে শান্তি সম্ভব হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
{إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللَّهِ الْإِسْلَامُ} [آل عمران : 19]
নিশ্চই ধর্ম একমাত্র আল্লাহ তাআলার নিকট ইসলামই ৷ অর্থাৎ,নিজের ইচ্ছা কে আল্লাহর কাছে সপে দেওয়া।
{ ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَّةً} [البقرة : 208]
তোমরা শান্তির ধর্ম ইসলামে পূর্ণরূপে প্রবেশ করো।
ইসলামের শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লাম -এর আগমণের পূর্বের ইতিহাসও সুপ্রসিদ্ধ। যে সময়ে মেয়েরা ছিলো অবহেলিত। লাঞ্ছনা ও বঞ্চনার পাত্র। জীবন্ত পুতে ফেলা হতো তাদের। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরস্পর লড়াই করতো। বিদ্বেষের এই লড়াই চলতো যুগযুগ ধরে। তখন হারিয়ে গিয়েছিলো মানবতা। রাসূলে আরাবির আগমনের পর নবুওয়াতি মেহনতের উৎকর্ষ সাধনে দূর হলো মানবতার হাহাকার। বন্ধ হলো সকল গর্হিত কাজ।
হিংস্র চরিত্রের মানুষগুলো হয়ে গেলো ফেরশতা সুলভ আখলাকের অধিকারী। যুদ্ধের ময়দানে পানির তৃষ্ণায় ফেটে যাচ্ছে ছাতি। এমন সময় পাশ থেকে আওয়াজ আসল পানি পানি। তখন নিজে পান না করে পাঠিয়ে দিলেন পাশের ভাইয়ের জন্য। ইসলামের ছায়াতলে এসে এমনই হয়েছিল তাদের আদর্শ। এজাতীয় অনেক ঘটনা নির্ভরযোগ্য ইতিহাসগ্রন্থে সংরক্ষিত আছে।
ইসলামের বাণী,
المسلم من سلم المسلمون من لسانه ويده
“যার হাত ও মুখ থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদ থাকে সেই প্রকৃত মুসলিম”। অর্থাৎ তার চলা ফেরা আচার আচরণ ইত্যাদি বিষয়ে যেন কেউ কোন কষ্ট না পায়। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং১০)
সামাজিক জীবনে অশান্তির যে কারণ রয়েছে, তা দূর করতে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছে ইসলাম। ইসলামে পর্দার বিধান সমাজ থেকে উলংগপনা ও ইভটিজিং দূর করার যথাপোযুক্ত ঔষধ। মাদক নিষিদ্ধ করণ অনৈতিকতা রোধে এক সফল পদক্ষেপ। ক্রোধ, হিংসা, লোভ-লালসা,অহংকার ইত্যাদি যা সমাজ দুষণে গুরুত্তপুর্ণ ভূমিকা পালন করে,তা দূরীকরণে ইসলামের সমাধানও খুব চমৎকার।
সর্বোপরি একজন মানুষকে শুধু বাহ্যিক শাস্তির ভয়ে এসব থেকে বিরত রেখে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। বরং ঐ মহান সত্ত্বার প্রতি বিশ্বাস। যিনি সর্বদা আমাদের প্রত্যক্ষ করছেন। মনের অবস্থা সম্পর্কেও সম্যক অবগত। এবং অবধারিত মৃত্যু পরবর্তি শাস্তির ভয়ই কেবল পারে ঐ সব গর্হিত কাজ হতে বিরত রেখে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে।
পৃথিবীর সবাই শান্তি, সমতা ও ঐক্যের পক্ষে নয়। অনেকে তা বিঘ্নিত করতে চায় নিজের কায়েমি স্বার্থ রক্ষার জন্য। ফলে শান্তির প্রবাহকে নির্বিঘ্ন করার জন্য কখনো কখনো শক্তি প্রয়োগ দরকার হয়। ঠিক যে কারণে পুলিশ,সেনাবাহিনী ইত্যাদি, যা সকল দেশে বিদ্যমান। শুধু শান্তি ও সুবিচারগুলো নিশ্চিত করার জন্যই ইসলাম শক্তি ব্যবহারের অনুমতি দেয়। যাতে শান্তি ও সুবিচার বিরোধীরা সংযত থাকতে বাধ্য হয়। ইসলামে এর নামই জিহাদ।
অনেক অমুসলিম ঐতিহাসিকও এই বাস্তবতা স্বীকার করেছেন যে ইসলাম তরবারীর মাধ্যমে বিস্তার লাভ করেনি। কারণ মুসলিমরা আটশত বছর স্পেন শাসন করেছে। সেখানে কখনো কাউকে ইসলাম গ্রহণের জন্য তরবারী ব্যবহার করা হয়নি। বরং পরর্বতিতে খ্রীষ্টান ধর্মযোদ্ধারা স্টেনো এসে মুসলমানদের এমন ভাবে বিতাড়ন বা ধর্মান্তর করে যে সমগ্র স্পেনে প্রকাশ্যে আযান দেয়ার মত কেউ ছিলো না।
চৌদ্দশ বছর ধরে মুসলমানরা আরবের অধিপতি, অথচ আজও সেখানে চৌদ্দ মিলিয়ন বংশগত খ্রীষ্টান রয়েছে। ইসলাম যদি তরবারির মাধ্যমে হতো তাহলে কি আরবের অবস্থা হতোনা স্পেনের মত, আর খ্রীস্টানরা যদি তরবারী ব্যবহার না করতো তাহলে স্পেনের অবস্থা আরবের মতো? ভারত তো আরো বড় প্রমাণ, যেখানে মুসলিমরা হাজার বছর শাসন করেছে। যদি চাইতো তাদের ক্ষমতা ছিলো প্রত্যেক অমুসলিমকে শক্তিবলে ধর্মান্তরিত করার। এর চেয়ে আর বড় প্রমাণ আর কী যে, ইসলাম তরবারীর ছায়ায় বিস্তার লাভ করেনি। ইন্দোনেশিয়া পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার দেশ, মালায়শিয়াতেও বেশির ভাগ মুসলিম,তাহলে কোন মুসলিম সৈন্যদল সেখানে তরবারীহাতে গিয়েছিল? একইভাবে আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে কোন মুসলিম বাহিনী তরবারী চালিয়েছিল? এমনকি তরবারী থাকলেও ইসলাম প্রসারে কেন মুসলমানের তা অন্যায় ব্যবহারের অনুমতি ছিল না। কেননা কুরআনেই মহান আল্লাহ তায়ালা আদেশ প্রদান করেছেন
{لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ } [البقرة : 256]
ধর্ম গ্রহণের ক্ষেত্রে কোন বলপ্রয়োগ নেই।সত্য অসত্য থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে।(বাকারা:২৫৬)
বরং বলা হয়েছে বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার কথা:
{ادْعُ إِلَى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُمْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ} [سورة النحل : 125]
তোমার রবের দিকে ডাক প্রজ্ঞা ও সদোপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে যুক্তি প্রদর্শন কর সর্বোত্তম ভাবে।(সূরা নাহাল:১২৫)
রিডার্স ডাইজ্যেস্ট “আলমানাক” বর্ষসংখ্যা ১৯৮৬ এর একটি প্রবন্ধে ১৯৩৪ থেকে ৮৪ এই অর্ধশত বছরে বিশ্বের প্রধান ধর্মানুসারীদের শতকরা বৃদ্ধির পরিসংখ্যান দেয়া হয়। উক্ত পরিসংখ্যান মতে মুসলমানদের বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ২৩৫% এবং খ্রীষ্টানদের মাত্র ৪৭%। কেউ কি জিজ্ঞাসা করবে এই শতাব্দিতে মুসলমানরা কোন যুদ্ধ করেছে যার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষ ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছে?
এত্তোসব পরিসংখ্যান বাস্তব সত্য। অথচ ইহুদি- খৃস্টান চক্র ইসলামের বিরুদ্ধে মহা পরিকল্পনা মাফিক চক্রান্তের অংশ হিসেবে পুরো বিশ্বে জঙ্গিবাদ নামের ব্যাপক প্রসার ঘটিয়েছে। এর সাথে জুড়ে দিয়েছে ইসলামের নাম। একবিংশ শতাব্দির শুরু থেকে তারা এব্যাপারে ব্যাপক প্রচারনদণা চালিয়ে যাচ্ছে। একজন বিবেকবান মানুষ মাত্রই বুঝবেন,এই শতাব্দির শুরু থেকে অদ্যাবধি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেমন আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, ইরাক, লিবিয়া, পাকিস্তানসহ বহু জায়গায় সন্ত্রাস দমনের নামে জঙ্গিবাদি কার্জ কলাপ করা হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদেরর বিস্তারে ইহুদি – খ্রীষ্টান অপশক্তি বা তাদের দোসরদের মাধ্যমেই জঙ্গিবাদ সংঘটিত হচ্ছে। ইসলামের সাথে যার বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই তাদের চক্রান্তের অংশ হিসেবে আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশেও একই কার্জক্রম চলছে। প্রতিদিন, প্রতি সপ্তাহ, প্রতি মাস, প্রতি বছরে শতশত মানুষকে বিনা কারনে মেরে ফেলা হচ্ছে।
জঙ্গিবাদ মানে যদি হয়, জঙ্গি তথা সন্ত্রাসী ও মানবতা বিরোধী কার্জ কলাপ। তাহলে এগুলোকে জঙ্গিবাদ বলাই সবচেয়ে যথার্থ কি? অথচ ইহুদি, খৃস্টানদের এদেশেও এক শ্রেণীর লোক জঙ্গিবাদের সাথে ইসলামের নাম সংযুক্ত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত। সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে, ইসলামী শিক্ষার মৌলিক সুতিকাগার মাদরাসাকে। যেখানে শিক্ষা দেওয়া হয় মানবতা। গড়ে তোলা হয়, প্রকৃত মানুষরূপে। দেশ স্বাধীন হওয়ার থেকে এখন পর্যন্ত মাদরাসা কর্তৃক জঙ্গিবাদ ঘটনার কোন শতভাগ সত্য প্রমাণ আছে কি? মাদরাসার ছাত্ররা কয়টি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। শতকরা হিসেবে তার পরিমাণ কত ! এই মাদরাসাগুলোয় শিক্ষা দেওয়া হয় শান্তিপূর্ণভাবে ইসলাম পালনের ও তা প্রচারের। ইসলামী শিক্ষা বা মাদরাসা শিক্ষার কোথাও জঙ্গিবাদের কোন স্থান নেই।
আমাদের উপমহাদেশে বরং সারা পৃথিবীতে শান্তিপূর্ণভাবে ইসলাম প্রচারে সর্বাধিক ভূমিকা রেখেছে কওমী ওলামায় কেরাম বা ওলামায়ে দেওবন্দ। যার উজ্জল দৃষ্টান্ত তাবলীগ জামাত। যা নয়া দিল্লী থেকে শুরু হয়ে সুদূর ইউরোপ। আটলান্টিক পেরিয়ে আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়াসহ পৃথিবীর প্রায় সকল দেশে শান্তিপূর্ণভাবে ইসলাম প্রচার করছে। এর প্রতিষ্ঠাতা হযরতজ্বী মাওলানা ইলিয়াস রহ. যিনি সকল কওমী মাদরাসার প্রাণকেন্দ্র দারুল উলুম দেওবন্দেরই একজন স্বনামধন্য কৃতি সন্তান। চিন্তা-চেতনায়, ধ্যান-ধারনা সকল ক্ষেত্রেই তিনি দেওবন্দি আকাবীরের প্রতিচ্ছবি ছিলেন।
মানুষের বাহ্যিক সংশোধনের সাথে আত্মিক ও রুহানী আত্মদ্ধির জন্য সঠিক তাসাউফের সিলসিলা ও অব্যাহত রেখেছেন ওলামায়ে দেওবন্দ। আল্লাহ তায়ালা ওলামায়ে দেওবন্দের মাধ্যমে শান্তির ধর্ম ইসলামকে পৃথিবীর আনাচে কানাচে সর্বত্র পৌঁছান। এই প্রার্থণা করছি তার দরবারে। আমীন।