আমীরে শরীয়ত মুজাহিদে মিল্লাত হজরত মাওলান মুহাম্মাদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহঃ)
জন্ম ও বংশ পরিচয় : আমীরে শরীয়ত মুজাহিদে মিল্লাত মুহাম্মাদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহঃ) সাবেক নোয়াখালী বর্তমান লক্ষীপুর জেলার রায়পুর থানধীন লুধুয়া গ্রামে ১৩১৩ হিজরী মোতাবেক ১৮৯৫ ইং এক দ্বীনদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মাওঃ ইদ্রিস এবং দাদার নাম মিয়াজী আকরাম উদ্দীন। মাওলানা ইদ্রিস সাহেব ছিলেন উর্দু – ফার্সি ভাষার সুদক্ষ বিজ্ঞ আলেম ও মুবাল্লেগ। হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ) ছিলেন মাওলানা ইদ্রিস সাহেবের নয় ছেলে ও পাঁচ মেয়ের মধ্যে পঞ্চম।
প্রাথমিক শিক্ষা : ইসলামী শিক্ষার মধ্য দিয়েই শুরু হয় তাঁর শিক্ষাজীবন। বিশিষ্ট আলেম বুজুর্গ একমাত্র চাচা মাওঃ মোঃ ইউসুফ সাহেবের নিকট তিনি বিসমিল্লাহ্ – এর সবক গ্রহণ করেন। হাফেজ্জী হুজুর (রহঃ) চাচাজানের নিকট প্রাথমিক আরবী ফার্সী শিক্ষা লাভের পাশাপাশি ঈশ্বরচন্দ্র পণ্ডিত নামক জনৈক হিন্দু শিক্ষকের নিকট প্রাথমিক বাংলা ভাষা শিক্ষা লাভ করেন।
মাদ্রাসা শিক্ষা : সর্বপ্রথম মাওলানা ওসমান সাহেবের মাদ্রাসায় ভর্তি হন। অতপর তিনি লক্ষীপুর থানার অন্তর্গত খিল বাছাই মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে লেখাপড়া শুরু করেন। এখানে তিনি ফার্সী ভাষায় রচিত আল্লামা শেখ সাদীর গুলিস্তাঁ ও বুস্তাঁ, আখলাকে মুহসেনী, ইউসুফ যোলায়খা প্রভৃতি কিতাব এবং নাহু-সরফের মীযান, মুনশাইব, নাহুমীর, হেদায়াতুন্নাহু সহ সংশ্লিষ্ট জামাতগুলোর বিভিন্ন বিষয়ের কিতাবসমূহ অধ্যায়ন করেন।
মারিফতের সন্ধানে : হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রঃ) – এর মধ্যে যেমন ছিল ইলমে ইলাহীর পিপাসা, তেমনই ছিল মারিফাতে ইলাহির প্রেরণা। ইলমে নববী হাসিলের জন্য যেমন দক্ষ ও অভিজ্ঞ উস্তাদ খুঁজতে ছিলেন অনুরূপ মারিফাতে ইলাহীর প্রেরণায় পীর দরবেশদেরও মনে মনে খোঁজ করতেন। জায়গীর বাড়ি ছিল দরবেশ ও সুফি সাহেবের। হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রঃ) দরবেশ সাহেবের যিকির-আযকার দেখে তার প্রতি ঝুঁকে পড়লেন এবং সকাল-বিকাল তার সঙ্গে যিকিরে যোগ দিতে লাগলেন। দরবেশ সাহেব হযরত হাফেজ্জী (রঃ) এর এই আগ্রহ লক্ষ্য করে বিভিন্ন মজলিসে তাকে নিয়ে যেতেন। হজরত হাফেজ্জী (রঃ) এর অভ্যাস ছিল গুনাহ থেকে দূরে থাকা অনর্থক কথা কাজে লিপ্ত না হওয়া। সর্বদা আল্লাহর যিকির করা ছিল তার অন্তরের নেশা। তার হৃদয়ে আল্লাহ ওয়ালা হওয়ার বাসনা প্রবল হতে লাগল। বিশ্ব কবি শেখ সা’দীর বোস্তা কিতাবের এ কবিতাটি যেদিন তিনি উস্তাদের নিকট পড়ে ছিলেন,
چوں روزےبہ بيچار گى جاں دہى * بس آں بہ برپائے جانان د ہى
অর্থ “নিঃস্ব রূপে যখন তোমার প্রাণ দিতেই হবে, তখন সেই প্রাণটি প্রিয়তমের চরণে লুটিয়ে দেওয়াই তো তোমার জন্য উত্তম।” সে দিন থেকেই তার মনে সৃষ্টি হল পৃথিবীর প্রতি এক চরম অনিহা। আকাবিরের সংস্পর্শে সাধনাদীপ্ত উজ্জল জীবন গড়ার প্রত্যয়ে, আল্লাহর প্রেমে সমৃদ্ধ আদর্শ মানুষ হওয়ার জন্য বার বার তার মন ছুটে গেছে দ্বীন ও ইলমে ইলাহীর নানা কেন্দ্রের দিকে। মন কখনো ছুটেছিল দারুল উলূম দেওবন্দের দিকে, কখনো মাজাহেরুল উলূমের দিকে, কখনো অন্তরে ভেসে উঠেছিল হাকিমুল উম্মত হযরত থানভী (রঃ) এর কথা। হযরত থানভী (রঃ) এর সাথে প্রথম সাক্ষাৎ হয় পানিপথে। তারপর ছাত্র যমানায় বার বার আসা যাওয়া ও সাক্ষাৎ হতে থাকে। পড়াশুনার পর হযরত থানভী (রঃ) এর হাতে বাইয়াত হন এবং খেলাফত লাভ করেন।
উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে ভারত গমনঃ হজরত হাকিমুল উম্মত থানভী (রঃ) এর নিকট থানা ভবন গিয়ে হযরতের পরামর্শে ১৩৩৩ হিজরী মোতাবেক ১৯১৫ ইং থেকে ১৩৪০ হিজরী মোতাবেক ১৯২২ ইং পর্যন্ত সর্বমোট সাত বছর কাল তিনি সাহারানপুর মাযাহিরুল উলূম মাদ্রাসায় পড়ালেখা করেন।
দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তিঃ– ১৩৪০ হিজরী মোতাবিক ১৯২৩ ইং মাযাহিরুল উলূম সাহারানপুর থেকে ইলমে হাদীসের সনদ লাভ করে ১৩৪১ হিজরী মোতাবিক ১৯২৪ ইং দারুল উলূম দেওবন্দে পুনরায় দাওরা হাদীসে ভর্তি হন। কেননা তার বহু শখ ছিল হযরত আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশমীরী (রঃ) এর নিকট বুখারী পড়ার।
কর্মজীবন- পড়া শেষে তিনি তার সাথী হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রঃ) ও মাওলানা আব্দুল ওয়াহহাব (রঃ) সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দেওবন্দের নকশা অনুযায়ী নতুন নতুন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন। তারা প্রথমে যোগ দেন ব্রাক্ষণবাড়িয়া মাদ্রাসায়ে ইউনুসিয়ায়। এরপর তাদের প্রচেষ্টায় বাগেরহাট ও ঢাকার বড় কাটারা, লালবাগ ও ফরিদাবাদে বড় বড় মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পরে ঢাকার কামরাঙ্গীর চরে হযরত হাফেজ্জী হুজুরের একক প্রচেষ্টায় প্রায় ১৮-২০ একর জমির উপর নুরীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা হয়।১৯৮১ ইং তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ গ্রহণের মাধ্যমে সক্রিয় রাজনীতিতে অবতির্ণ হন। নির্বাচনের পরে ১৯৮১ ইং ২৯ শে নভেম্বর তিনি খেলাফত আন্দোলন নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠনের সূচনা করেন।
শিক্ষকবৃন্দঃ-
# শাইখুল ইসলাম সায়্যিদ হুছাইন আহমদ মাদানী (রঃ)
# আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী (রঃ)
# শাইখুল আদব আল্লামা এযায আলী (রঃ) প্রমুখ।
শাগরেদবৃন্দঃ
তার ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন
# শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক (রঃ),
# আল্লামা মুফতি ফজলুল হক আমীনী (রঃ)।
# হযরত মাওলানা সৈয়দ ফজলুল করীম পীর সাহেব চরমোনাই (রঃ)
# হযরত মাওলানা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী (দাঃবাঃ),
# পীরে কামেল হযরত মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ (দাঃবাঃ) প্রমুখ।
ওফাতঃ- ৭ মে ১৯৮৭ ইং মোতাবিক ৮ ই রমজান ১৪০৭ হিজরী রোজ বৃহস্পতিবার সোহরা্ওয়ার্দী হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। ঢাকা কামরাঙ্গীরচরে নুরিয়া মাদ্রাসায় তাকে পার্শ্বে দাফন করা হয়।