হজ্বের প্রস্তুতি
১. হজ্বে গমনকারীর জন্য সর্বপ্রথম কাজ হলো নিজের নিয়তকে বিশুদ্ধ করা। কারণ বিশুদ্ধ নিয়ত ছাড়া আল্লাহ তাআলা বান্দার কোন ইবাদত কবুল করেন না। অন্তরে যেন বিন্দু পরিমান লৌকিকতা-লোক দেখানো, কারো কাছে প্রশংসিত হওয়ার মানসিকতা না থাকে বরং একমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিই যেন উদ্দেশ্য থাকে।
২. হজ্বের উদ্দেশ্যে বের হওয়া যেন দুনিয়া ত্যাগ করার মত হয়ে যায়, সুতরাং নিজের জীবনের অতীতের সমস্ত কবীরা-সগীরা গুনাহের কথা স্মরণ করে অনুতপ্ত এবং ভবিষ্যতে গোনাহ না করার দৃঢ় সংকল্প করে মহান আল্লাহর দরবারে তাওবা-এস্তেগফার করা এবং তাওবার নিয়তে দু’ রাকাত নামায আদায় করা।
৩. নিজের উপর কারো আর্থিক বা দৈহিক হক্ব থাকলে তা যথাসম্ভব পরিশোধ করা। অসামর্থবান হলে ক্ষমা চাওয়া এবং হকদার ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে তার উত্তরাধিকারীদের সাথে আর্থিক বিষয়টি নিষ্পত্তি করা এবং তাও যদি সম্ভব না হয় তাহলে সমপরিমাণ অর্থ ঐ হকদারের জন্য (প্রাপ্যব্যক্তির) সওয়াবের নিয়তে সদকা করা।
৪. হজ্বে যাওয়ার পূর্বে পরিবার পরিজনের খোর-পোষের ব্যবস্থা করে যাওয়া। কোন বিষয়ে নির্দেশনা থাকলে ওয়ারিশদের ওসিয়ত করে যাওয়া।
৫. অবশ্যই হালাল উপার্জন নিয়ে হজ্বে যাওয়া উচিৎ। কেননা হারাম উপার্জন দিয়ে হজ্ব করলে তা কবুল হবে না, যদিও হজ্ব করার কারনে হজ্ব করার দায়িত্ব আদায় হয়ে যাবে। ইমাম গাজালী রহ. বলেন কেউ যদি হারাম উপার্জন দিয়ে হজ্ব করে তাহলে সে যেন হজ্বের সফরে নিজের খানা হালাল উপার্জন দিয়ে করে, তা যদি সম্ভব না হয় তাহলে ইহরাম অবস্থায় হারাম টাকা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করবে। তাও যদি সম্ভব না হয় তাহলে কমপক্ষে আরাফার দিন হারাম খানা থেকে বিরত থাকবে। কোন ব্যক্তি যদি হজ্বের ইচ্ছা পোষণ করে আর তার কাছে হালাল উপার্জন না থাকে তাহলে সে হারাম সম্পদ ব্যবহার না করে ঋণ করে হজ্ব করবে এবং পরবর্তীতে তা পরিশোধ করে দিবে।
৬. সুদকে নিজের জীবনের জন্য সর্বাবস্থায় হারাম হিসেবে গণ্য করে সুদের উৎসমূল নির্মূলে সচেষ্ট হওয়া। ঘুষ, প্রতারণা, পরের সম্পদ আতœসাৎ, যাদুবিদ্যা চর্চা ও বিশ্বাস এবং জুয়া ইত্যাদি যাবতীয় নিষিদ্ধ সকল গর্হিত কাজ থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকার অঙ্গীকার করা।
৭. শিরক, বিদআত, গীবত, অহংকার পরনিন্দা, হিংসা-বিদ্বেষ সম্পূর্ণ পরিহার করা এবং হজ্বের পরেও এর উপর সুপ্রতিষ্ঠিত থাকা।
অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায়, হাজ্বীগণ হজ্ব চলাকালীন সময়েও কাফেলার রাহবার, খাওয়া-দাওয়া এবং ব্যক্তি সমালোচনায় লিপ্ত থাকে। হজ্ব আদায় হওয়ার ক্ষেত্রে এ সব কাজ বড় বাধা হতে পারে।
৮. ঋণ থাকলে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি পরিশোধ করা এবং বিষয়টি সময়সাপেক্ষ হলে উত্তরাধিকারীদের তা অবগত করানো। যাতে যে কোন দুর্ঘটনায় তারা তা আদায় করতে পারে।
৯. নিজের স্ত্রীর মোহরানা বাকি থাকলে হজ্বের পূর্বেই তা আদায় করার চেষ্টা করা। অথবা স্ত্রীর স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি বা পারস্পরিক সমাঝতায় ব্যবস্থা করা ও স্ত্রী, পুত্র-কন্যা তথা পরিবার পরিজনকে তাকওয়ার নীতি অবলম্বনে ইসলামের উপর অটল থাকার জন্য কড়া নির্দেশ দেয়া।
১০. হজ্বে যাওয়ার পূর্বে জীবিত পিতা-মাতার খেদমতের সুব্যস্থা করা, তাদের মনে কষ্ট দিয়ে থাকলে ক্ষমা চেয়ে নেয়া এবং হজ্বে তাদের কথা স্মরণ করে বার বার দোয়া করা।
১১. অপ্রয়োজনীয় কথা না বলে বেশি বেশি জিকির করা এবং সকল স্থানে নারী-পুরুষ সকলের উচিৎ দৃষ্টিকে সংযত করে রাখা এবং সর্বাবস্থায় আল্লাহর সাহায্য চাওয়া।
১২. মক্কা-মদীনায় দর্শনীয় মোবারকময় স্থান দেখতে গিয়ে কোন ক্রমেই পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের কোন জামাত যাতে না ছুটে সে দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা।
সফরের সামানাদি
১. হজ্বের সফরের সবচেয়ে বড় পাথেয় ও সামান হলো তাকওয়া তথা খোদাভীতি অর্থাৎ এ সফরে অন্তর দিয়ে দৃঢ় সংকল্প করা যে, এই সফরে কোন ধরনের অন্যায় করবো না। কদম কদম আল্লাহর স্মরণ দিলের মাঝে স্থাপন করা।
২. হজ্বের সাথী নির্বাচনে খুবই সচেতন ও সতর্ক থাকা। নিম্নে হজ্ব সাথীদের কিছু গুনাগুণ বয়ান করা হলো-
ক. নেককার-মুত্তাকী হওয়া।
খ. জ্ঞানী-বুদ্ধিমান হওয়া।
গ. ইতিপূর্বে হজ্বের সফর করেছে এমন হওয়া।
ঘ. কোমল চরিত্র ও নরম ব্যবহারের অধিকারী হওয়া।
ঙ. ভুলকাজে সতর্ক করতে পারে ও ভালোকাজে উৎসাহিত করতে পারে এমন গুণের অধিকারী হওয়া।
চ. আলেম ও মুফতী হলে সোনায় সোহাগা।
এ সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না দেখে হাজ্বী সাহেবগণ স্বাভাবিকভাবে জাগতিক সুবিধার খোঁজ-খবর নিয়ে থাকেন অনেক যত্নসহ, তারা দেখেন কোন ট্র্যাভেলস কত টাকা কম নিতে পারে, কোন কাফেলায় গেলে খাওয়া-দাওয়া এবং বাসা ও আরামের ব্যবস্থা বেশী করতে পারে সে বিষয়টাই লক্ষ্যতে পরিণত হয়েছে। আর উপরে বর্ণিত বিষয়গুলোর কথা খেয়ালই করে না। যা নিতান্তই ভুল। কেননা সবকিছু থেকে এটাকেই গুরুত্ব দেয়ার দরকার যে, আমার হজ্ব আমার আমল, আমার সফর সবই যেন আল্লাহর নৈকট্য অর্জন, আল্লাহর ইশ্ক-প্রেম ভালোবাসার নমুনা ও সন্তুষ্টির মাধ্যম হয়ে যায়। আর এর জন্য উপরোল্লিখিত গুণের সাথী অনেক সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।
৩. হজ্বের জন্য যে সব জিনিস না নিলেই নয় তা পূর্ব থেকেই সংগ্রহ করা এবং সকল ক্ষেত্রে অপর হাজ্বী ভাইয়ের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া।
আয়না, চিরণী, সুঁই, সুতা, মিসওয়াক, কেচি, ব্লেড, রেজার, টয়লেট পেপার, রশি, ব্যবহারের প্রয়োজনীয় কাপড়, এহরামের দুই সেট কাপড়, দুই জোড়া জুতা, কাপড় ধোয়ার সাবান, গোসলের সাবান, অভ্যাস হিসেবে ব্যবহারের সরীষার তৈল অথবা লোসন, টুথপিক, কটন ইত্যাদি।
৪. প্রয়োজনীয় টাকা-পয়সা সাবধানে-হেফাজতে রাখা।
৫. নিজের লাগেজ ও ব্যাগে ইংরেজীতে নিজের নাম-ঠিকানা ও বাড়ীর কারো মোবাইল নাম্বার এবং ট্র্যাভেল্স ও মুআল্লিমের নাম্বার লিখে নেয়া।
৬. হজ্ব শ্রমসাধ্য ব্যপার। এ জন্য যতোটুকু সম্ভব নিজেকে তৈরী রাখা এবং ব্যথা, সর্দি-কাশি, রক্তচাপ ও ডাক্তারের নির্দেশিত ঔষধ সংগ্রহ করে নিয়ে যাওয়া।
৭. ছোট ডায়েরী ও খাতায় মক্কা-মদিনার ঠিকানা, জানাশোনা দু’-একজনের মোবাইল নাম্বার সৌদি আরব ও দেশের কিছু লোকের নাম্বার লিখে নিজের কাছে সংরক্ষণ করা।
সফরে আল্লাহর মেহমানদের সাথে কোমল আচরণ করা
১. মনে রাখতে হবে সারা দুনিয়া থেকে যতো লোক হজ্বের নিয়তে উপস্থিত হয়েছে সবাই আল্লাহর ঘরের মেহমানদের সাথে সম্মান ও মর্যাদার আচরণ করা।
২. চলাফেরা ও আচার-আচরণে বিন¤্র হওয়া।
৩. হজ্বেও সাথীদের আক্রমাত্মক আচরণ ও কথাবার্তাকে ধৈর্যের সাথে এড়িয়ে যাওয়া।
৪. কারো আচরণে কষ্ট পেলে মাফ করে দেয়ার মানসিকতা রাখা এবং প্রতিশোধ নেয়ার মানসিকতা পরিহার করা।
৫. ঝগড়া-বিতণ্ডা, গীবত ও পরসমালোচনা থেকে বিরত থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা।