প্রচলিত শেয়ার ব্যবসা : উলামায়ে কিরামের মতামত ও আমাদের করণীয়
-মুফতী ইঊসুফ সুলতান
ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। মানব জীবনের এমন কোনো দিক নেই যে সম্পর্কে ইসলাম সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয় নি। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন,
وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَانًا لِّكُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَحْمَةً وَبُشْرَىٰ لِلْمُسْلِمِينَ ﴿النحل: ٨٩﴾
আমি আপনার প্রতি গ্রন্থ নাযিল করেছি যেটি এমন যে তা প্রত্যেক বস্তুর সুস্পষ্ট বর্ণনা, হেদায়েত, রহমত এবং মুসলমানদের জন্যে সুসংবাদ। (১৬ : ৮৯)
ইসলাম যেমন নামায, রোযা, যাকাত, হজ্জ্ব ইত্যাদি ইবাদত সম্পর্কে দিক-নির্দেশনা দেয়, তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্য, পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক, রাষ্ট্রীয় ও কূটনৈতিক সম্পর্ক, আইন-কানুন ইত্যাদি জীবন ঘনিষ্ঠ অন্যান্য বিষয় নিয়েও ইসলাম কথা বলে।
বর্তমান সময়ে শেয়ার ব্যবসা একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক লেনদেন। কম-বেশি প্রায় চল্লিশ লক্ষ্য পরিবার আমাদের দেশে এ ব্যবসার সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জড়িত। মুসলিম প্রধান এ দেশে বহুল প্রচলিত এ ব্যবসা সম্পর্কে তাই আলেম-উলামার সুস্পষ্ট বক্তব্য জনসম্মুখে আসা প্রয়োজন। সে লক্ষ্যেই জামিয়াতুল আস’আদ আল ইসলামিয়া ঢাকা ধারাবাহিক ফিক্বহী মাক্বালা প্রতিযোগিতা-২ এর বিষয় হিসেবে ‘প্রচলিত শেয়ার ব্যবসা’ নির্ধারণ করেছে।
প্রতিযোগিতায় যেসব মাক্বালা বা প্রবন্ধ জমা পড়েছে সেসব প্রবন্ধের সার বক্তব্য তুলে ধরাই এই প্রবন্ধের মূল লক্ষ্য। ইনশা’আল্লাহ আমরা সংক্ষেপে বিষয়গুলো আলোচনা করার প্রয়াস চালাবো।
শেয়ার ব্যবসা কী?
খুব সহজে বললে, দুই তিনজন মিলে কোনো ব্যবসা করাই শেয়ার ব্যবসা। শেয়ার অর্থ অংশিদারিত্ব। দুই বা ততোধিক ব্যক্তির অংশিদারিত্বে যে ব্যবসা পরিচালিত হয়, প্রকৃত অর্থে তা-ই শেয়ার ব্যবসা।
তবে প্রচলিত শেয়ার ব্যবসার ধরণ প্রকৃত অর্থে শেয়ার ব্যবসা থেকে খানিকটা ভিন্ন।
প্রচলিত শেয়ার ব্যবসা বলতে মূলত সেকেন্ডারী মার্কেটে শেয়ারের মালিকানার ক্রয়-বিক্রয়কে বোঝায়। কোম্পানী থেকে প্রথমবার শেয়ার একজন ক্রয় করে পরবর্তীতে তা সেকেন্ডারী মার্কেটে হাতের পর হাত বদল হতে থাকে। এর সাথে কোম্পানীর মূলধন, এ্যাসেট ইত্যাদির প্রায় কোনো সম্পর্কই থাকে না। বরং, নিজস্ব গতিতে সেকেন্ডারী মার্কেটে শেয়ারের দাম ওঠা-নামা করে। চলে সরাসরি ও ব্রোকারেজ হাউজের মাধ্যমে এসবের ক্রয়-বিক্রয়।
ব্যবসা সম্পর্কে শরীয়তের মূলনীতি : ব্যবসা সম্পর্কে শরীয়তের মূলনীতিটি খুব সহজ। আল-কুরআনের ভাষায় :
وَأَحَلَّ اللَّهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا ﴿البقرة: ٢٧٥﴾
আল্লাহ ক্রয়-বিক্রয় হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন।(২:২৭৫)
এই আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি :
১. যে কোনো ক্রয়-বিক্রয় মৌলিক ভাবে হালাল।
২. যে কোনো সুদভিত্তিক লেনদেন মৌলিক ভাবে হারাম।
এর অর্থ দাঁড়ায় এই যে, কোনো ব্যবসা সুদভিত্তিক হলে তা প্রথমেই হারাম। আর সুদভিত্তিক না হলে প্রথমেই তা হারাম নয়। তবে এতে যদি অন্য কোনো হারাম বিষয় থাকে তাহলে তা হারাম হবে। যেমন, ধোঁকা, জুয়া ইত্যাদি।
শেয়ার ব্যবসার বিধান সম্পর্কে আলেমদের মতামত :
আধুনিক ব্যবসা-বাণিজ্যের শরয়ী বিধানের ক্ষেত্রে আমরা আলেম ও ফকীহদের একাধিক মতামত দেখতে পাই। শেয়ার ব্যবসার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। এ ক্ষেত্রে আমরা মোটামুটি ৪ টি মতামত পেয়েছি।
মতামতগুলো উল্লেখ করার পূর্বে বলে রাখা ভালো যে, মূল ব্যবসা ও ব্যবস্থাপনার তারতম্যের ভিত্তিতে ফকীহগণ বাণিজ্যিক কোম্পানীগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন।
১. যেসব কোম্পানীর মূল ব্যবসা ও সকল লেনদেন শরীয়সম্মত ও সুদমুক্ত। এসব কোম্পানীর শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ে যদি গ্যাম্বলিংক না হয়, তাহলে তা সমকালীন প্রায় সকল ফকীহের মতে ক্রয়-বিক্রয় করা জায়েয।
২.যেসব কোম্পানীর মূল ব্যবসা হারাম। যেমন মদের ব্যবসা, সুদী ব্যবসা ইত্যাদি। এসব কোম্পানীর শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় জায়েয নেই।
৩.যেসব কোম্পানীর মূল ব্যবসা হালাল, তবে কোনো না কোনো ভাবে তা শরীয়ত বিরোধী কাজ বা সুদী লেনদেনের সাথে জড়িত। এ ব্যাপারে আমরা চারটি মতামত পাই।
১ম মত : এসব কোম্পানীর প্রাইমারী শেয়ার যদি এ উদ্দেশে কেনা হয় যে, মূল কোম্পানীতে অংশিদারিত্বের মাধ্যমে বছর শেষে লাভবান হবে (Divident পাবে), তাহলে ৪টি শর্ত সাপেক্ষে তা বৈধ হবে।
ক. কোম্পানীর মূল কারবার হালাল হতে হবে।
খ. Face Value বা শেয়ারের অভিহিত মূল্যের চেয়ে কম-বেশ করে ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে কোম্পানীর Liquid Asset (নগদ অর্থ ইত্যাদি) এর সাথে সাথে Fixed Asset (পণ্য, বিল্ডিং ইত্যাদি) উল্লেখযোগ্য পরিমাণ থাকা।
গ. কোম্পানীর AGM বা বার্ষিক সাধারণ সভায় সুদী লেনদেন বা শরীয়ত বিরোধী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা।
ঘ. কোম্পানীর আমদানীতে সুদ অন্তর্ভুক্ত হলে লভ্যাংশ থেকে সে হিসেবে সওয়াবের নিয়্যত ছাড়া সদকা করে দেয়া।
আর যদি Capital Gain এর জন্য শেয়ার ক্রয় করে থাকেন, যাতে কোম্পানীর লভ্যাংশ নয় বরং শেয়ারকে স্বতন্ত্র পণ্য হিসেবে কেনা-বেঁচা করাই মূল উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলেও পূর্বোক্ত শেষ দুই শর্ত সাপেক্ষে তা বৈধ হবে।
মুফতি তাকী উসমানী দা.বা. তাঁর বিভিন্ন ফাতওয়ায় ও প্রবন্ধ-নিবন্ধে এ অভিমত ব্যক্ত করেন।
২য় মত : এসব কোম্পানীর শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় কোনো ভাবেই বৈধ নয়। কেননা এতে প্রকারান্তরে কোম্পানীর শরীয়তবিরোধী কাজে সমর্থন দেয়া হয়। যা আল্লাহ নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,
وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَىٰ وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ ﴿المائدة: ٢﴾
সৎকর্ম ও খোদাভীতিতে একে অন্যের সাহায্য কর। পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করো না। (৫:২)
তাছাড়া ১ম মতের ১ম অংশের ক্ষেত্রে উল্লিখিত ‘খ’ ও ‘গ’ শর্তদুটো বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে অনেকটা অবাস্তব।
আর ২য় অংশে উল্লিখিত ক্রয়-বিক্রয়ে (Capital Gain এর ক্ষেত্রে) Speculation তথা শেয়ারের দরদাম বাড়া-কমার আন্দাজের ভিত্তিতে ক্রয়-বিক্রয়কে ক্বিমার বা জুয়া সাব্যস্ত করে শায়খ মুহাম্মদ আদদারী সহ অনেকে একে নাজায়েজ বলেছেন।
৩য় মত : শেয়ার ব্যবসার কোনো প্রকারই বৈধ নয়। এর মূল কারণ, শরীয়ত কোম্পানী নামের আইনসৃষ্ট ব্যক্তিকে সমর্থন করে না। কাজেই এর কোনো কাজই বৈধ নয়।
তাছাড়া কোম্পানীর শেয়ার ক্রয় কোম্পানীকে ঋণ দেয়ার নামান্তর। কাজেই এতে ঋণের বিধানানুসারে সুদ চলে আসে।
মুফতি ইবরাহীম দেসায়ী সহ অনেকেই এই মত পোষণ করেন। তাদের বক্তব্য হলো, মুফতি তাকী উসমানী দা.বা. যে অভিমত প্রকাশ করেছেন, তা তিনি তাঁর চূড়ান্ত মত হিসেবে প্রকাশ করেন নি। বরং তিনি এ ক্ষেত্রে আরো গবেষণা হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন।
মুফতি ইবরাহীম দেসায়ী দেওবন্দীর নেতৃত্বে সাউথ আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দারুল ইফতার মুফতীগণ দীর্ঘ গবেষণার পর প্রচলিত শেয়ার ব্যবসাকে পুরোপুরি অবৈধ বলে অভিমত প্রকাশ করেন।
৪র্থ মত :যেসব কোম্পানীর মূল ব্যবসা হালাল, কিন্তু তা সুদী লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত, সেসব কোম্পানীর শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় সুনিশ্চিত হারাম না হলেও যথেষ্ট সন্দেহযুক্ত। তাই এ ব্যবসা পরিত্যাগ করাই একজন মুত্তাকী মুসলিমের প্রথম দায়িত্ব।
উপসংহার : বর্তমান পুঁজিবাজার শরীয়তের দৃষ্টিতে যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ। সুদ, জুয়া, ধোঁকা –কী নেই এতে। রাসূল স. বলেন,
الإثم ما حاك في صدرك ، وكرهت أن يطلع عليه الناس
পাপ তা-ই যা তোমার অন্তরে খটকা লাগে। আর তুমি অপছন্দ করো যে মানুষ তা জানুক। –মুসলিম : ২৫৫৩
তিনি আরো বলেন,
الحلال بين ، والحرام بين ، وبينهما مشبهات لا يعلمها كثير من الناس ، فمن اتقى المشبهات استبرأ لدينه وعرضه ، ومن وقع في الشبهات : كراع يرعى حول الحمى يوشك أن يواقعه ، ألا وإن لكل ملك حمى ، ألا وإن حمى الله في أرضه محارمه
হালাল স্পষ্ট, হারামও স্পষ্ট। আর এ দুয়ের মাঝে আছে অনেক সন্দেহযুক্ত বিষয়, যা অনেকেই জানে না। যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত বিষয় থেকে বিরত থাকবে, সে তার দীন ও সম্মান বাঁচিয়ে রাখবে। আর যে সন্দেহ যুক্ত বিষয়ে নিমগ্ন হবে, সে ঐ রাখালের মতো যে অন্য মালিকের সীমানার কাছাকাছি তার প্রাণীগুলোকে চড়ায়। এটা খুবই সম্ভব যে তার প্রাণীগুলো অবৈধ সীমানায় ঢুকে পড়বে।
জেনে রাখো, প্রত্যেক মালিকেরই সীমানা রয়েছে। আর পৃথিবীতে আল্লাহর সীমানা হলো হারাম বিষয়। (এ সীমানার কাছেও যাওয়া উচিৎ হবে না)। -বুখারী : ৫২
শেয়ার ব্যবসা সম্পর্কে উলামায়ে কিরামের অভিমত ও এই হাদীসদ্বয়কে সামনে রেখে একজন মুসলিমের জন্য আমরা এটাই নিরাপদ ও তাকওয়ার কাজ মনে করি যে, তিনি প্রচলিত শেয়ার ব্যবসায় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সতর্ক হবেন। যেহেতু বিষয়টি এখনো আলেমদের গবেষণাধীন, তাই বিনিয়োগ না করাই শ্রেয়। আল্লাহ আমাদের হালাল ও হারাম বুঝে সতর্কতার সাথে বিনিয়োগ করার তাওফীক দিন। আমীন।
প্রামাণ্য গ্রন্থ :
শেয়ার ব্যবসার বিধান সম্পর্কে গবেষণার জন্য যেসব কিতাব প্রাথমিক ভাবে মুতালা’আ করা যেতে পারে :
- ফাতওয়ায়ে শামী; যাকারিয়া বুক ডিপো; খ:৭ পৃ:৫১৯
- ফাতওয়ায়ে মাহমূদিয়া : ” খ:২৪ পৃ: ২১৫
- ইমদাদুল ফাতাওয়া : ” খ:৩ পৃ: ৪৯১-৫০৫
- আপকা মাসায়েল আওর উনকা হল : ” ৬০-৬২
- জাদীদ ফিকহী মাসায়েল : নাঈমিয়া বুক ডিপো : খ:৪ পৃ: ১৬৭-১৭৪
- শিরকাত মুদারাবাত আসরে হাজির মে : ইদারাতুল মায়ারিফ
জাযাকাল্লাহ ভাই।