বেহেশতী জেওরের একটি মাসয়ালার ব্যাপারে অভিযোগ সম্পর্কে
নাজমুল কবীর
আস্সালামু আলাইকুম।
প্রশ্নঃ (এক) ভাই তাবলীগ জামাতের এক সাথীর কাছ থেকে বেহেশতি জেওরের বাংলা অনুবাদ (এমদাদিয়া লাইব্রেরী) নিয়েছিল। উক্ত বইয়ের দ্বিতীয় খন্ডের দাফন অংশে নিম্নোক্ত মাসয়ালাটি আছেঃ-
“৯। মাসআলাঃ কাফনের মধ্যে বা কবরের মধ্যে আ’হাদনামা, পীরের শাজ্রা অথবা অন্য কোন দো’আ কালাম লিখিয়া রাখা বা কাফনের উপর অথবা সীনার উপর কালী বা কার্পূর দ্বারা কোন দো’আ বা কালেমা-কালাম লিখিয়া দেওয়া জায়েয নহে। অবশ্য (খালি আঙ্গুলে কালেমা বা আল্লাহ্র নাম লিখিয়া দেওয়া বা) কা’বা শরীফের গেলাফ বা পীরের রুমাল ইত্যাদি বরকতের জন্য সঙ্গে দেওয়া জায়েয আছে।“
যেখানে, কাবা শরীফের গেলাফ বা পীরের রুমাল ইত্যাদি বরকতের জন্য মুর্দার কাফনের মধ্যে বা কবরের মধ্যে দেওয়া জায়েয বলা হয়েছে।
শেষের অংশটুকু পড়ার পর উনার মধ্যে সন্দেহ ঢুকেছে এবং লোকসম্মুখে প্রকাশ করছেন যে, এত এত মানুষ লেখককে (অর্থাৎ, হযরত আশরাফ আলী থানুভী রহ.-কে) বড় আলেম বলে থাকেন, অথচ এমন মাসয়ালা কিভাবে উনি উল্লেখ করেছেন!
অতএব, বিনীত নিবেদন- দয়া করে উক্ত বিষয়ের উপযুক্ত জবাব/প্রমাণ দিয়ে উনার এবং উনার মত অন্যদের সঠিক পথের দিশা দিবেন।
(দুই) হযরত মালেক বিন দিনার রহ. সম্পর্কে একটি ঘটনা ফাযায়েলে ছাদাকাত (দারুল কিতাব লাইব্রেরী)-এর শেষের দিকে উল্লেখিত ৭০টি ঘটনার ৫৭নং ঘটনায় উল্লেখ আছেঃ-
হযরত মালেক রহ. একটি কাগজের টুকরায় অঙ্গীকারনামা লিখে এক যুবককে দিয়েছিলেন যেটি পরবর্তীতে যুবকের কাফন ও শরীরের মধ্যে রেখে দেয়া হয়েছিল।
অর্থাৎ,বেহেশতী জেওরে উল্লেখিত উপরোক্ত মাসয়ালায় “লিখে দেয়া মানা করা হয়েছে”,ফাযায়েলে ছাদাকাতে বর্ণিত উক্ত ঘটনায় “কাগজে লিখে কাফনে রেখে দেয়া হয়েছে”। প্রশ্ন হলো উক্ত মাসায়ালাটি একটু বুঝিয়ে দিবেন,এই দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য কোথায় ?
بسم الله الرحمن الرحيم
وعليكم السلام و رحمة الله و بركاته
উত্তরঃ (এক) আমাদের মন মত বা জ্ঞানের মুয়াফিক না হলেও অনেক বিষয় ইসলামে হালাল কিংবা হারাম হতে পারে। এজন্য অবশ্য আমাদের জ্ঞানসল্পতাই দায়ী। তাই না জেনে বড়দের সম্পর্কে খারাপ ধারণা করা ঠিক না। যিনি ভিত্তিহীন সন্দেহের কারণে থানবী র. এর ব্যপারে এধরণের কথা বলছেনা আল্লাহ তাকে সহীহ বুঝ দান করুক।
বেহেশতী জেওরে যে মাসআলা লেখা হয়েছে তাতে কোন ভুল নেই। এখানে তিনি দু’টি মাসআলা উল্লেখ করেছেন। একঃ মৃতব্যক্তির কাফনে বা কবরে মাঝে কোন দো’আ কালাম বা কালিমা ইত্যাদি লিখে দেয়া জায়েজ নাই। কেননা এতে দোয়া কালাম কিংবা কালিমার অবমাননা হয়। অথচ এতে কোন ফায়দা নেই। আবার এরকম করার কোন প্রমানও হাদীসে নেই। পীরের শাজারা ও আহাদনামা এগুলো দিয়ে দিলেও কোন ফায়দা নেই। কেউ যদি এই বিশ্বাসে এগুলো মাইয়্যেতের সংগে দেয় যে, এগুলো সাথে থাকার কারণে তার কবরের আজাব হবে না বা হালকা হবে। তাহলে এধরণের বিশ্বাস রাখা তো ভুল। কেননা মৃত্যুর পর ব্যক্তির নেক আমলই কেবল কাজে দিবে। অন্যকিছু কবরের আজাব থেকে মুক্তি দিতে পারবে না। এজন্য এসকল কাজকে নাজায়েজ বলা হয়েছে।
কিন্তু দ্বিতীয় মাসআলা এর সম্পূর্ণ বিপরিত সেখানে বলা হয়েছে, বরকতের উদ্দেশ্যে যদি কাবা শরীফের গিলাফ কিংবা পীরের রুমাল ইত্যাদি বরকতের জন্য সংগে দিয়ে দেয় তাহলে তা জায়েজ আছে। এর জায়েজ হবার কারণ হল, বরকতের লাভের উদ্দেশ্যে মাইয়্যেতের সাথে বরকতময় কোন কিছু দিয়ে দেয়ার প্রমান হাদীস শরীফে এসেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার এক মেয়ের (উম্মে কুলসূম রা.)মৃত্যুর পর তার চাদর দিয়ে তার শরীর জড়িয়ে দিতে বলে ছিলেন।(সূত্রঃ সহীহ বুখারী, হাঃ ১১৮০) এটা যে বকতের উদ্দেশ্যে দেয়া হয়ে ছিল এব্যাপারে অনেক মুহাদ্দিসগনই লিখেছেন। (সূত্রঃ ফাতহুল বারী,৩/১২৯)
এরকম ভাবে কোন বুজুর্গ কিংবা বাইতুল্লাহ হতে বরকত হাসিল করাও জায়েজ আছে। সুতরাং বেহাশতী জেওরে থানবী র.কোন আজগুবি ভুল মাসআলা উল্লেখ করেননি। বরং উপরোক্ত হাদীস এই মাসআলাকে সমর্থন করে। আশা করি দু’টি মাসআলার মাঝে কি পার্থক্য তা সবাই ধরতে পারবে।
(দুই) বেহেশতী জেওরে উল্লেখিত মাসয়ালায় আহাদনামার ব্যাপারে “লিখে দেয়া মানা করা হয়েছে” এর পূর্বে “কবরের মধ্যে” শব্দটাও উল্লেখ আছে। অর্থাৎ সেখানে আহাদনামা লিখে কবরে দিয়ে দিতে নিষেধ করা হয়েছে। “আহাদনামা লিখে দেয়া নিষেধ” এমনটা বলা হয় নাই।
আর ফাযায়েলে ছাদাকাতের হযরত মালেক বিন দিনার র. সম্পর্কে ৫৭নং ঘটনায় যা উল্লেখ আছে তাতে একথা কোথাও নাই যে, তিনি এটা কবরে দিয়ে দিয়েছেন বা দিতে বলেছিলেন। বরং তিনি এই কাগজের টুকরা পেয়ে অত্যান্ত আশ্চার্যান্বিত হয়েছেন। ঐ যুবকের বাড়িতে যাবার পর তিনি জানতে পারেন তা কাফনের মাঝে দিয়ে দেয়া হয়েছিল। সুতরাং এই কাগজের টুকরা ঐ যুবকের কবরের মাঝে দিয়ে দেয়ার ব্যপারে কোন ভাবেই মালেক ইবনে দিনার র. কে দায়ী করা যায় না। আর ফাযায়েলে ছাদাকাতে তাদের এই কাজ বৈধ হয়েছে-না অবৈধ, তা বর্ণনা করা উদ্দেশ্য ছিল না। বরং এই ঘটনা উল্লেখের মূল কারণ কি ছিল তা পরিশিষ্টেই বলে দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি মালেক ইবনে দিনার র. কেন আহাদ নামা লিখেছেন তার ব্যাখ্যাও দেয়া হয়েছে।
সব সময় একটা বিষয় মনে রাখা অত্যান্ত জরুরী তা হল, যে কিতাব যে উদ্দেশ্যে লেখা হয়ে থাকে, তা সে উদ্দেশ্যেই তা পাঠ করা উচিত । যদি তা না করা হয়, তাহলে পদে-পদে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। একজন লেখক যখন এক দৃষ্টিকোণ থেকে কোন কিছু লেখে আর পাঠক তা যদি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পাঠ করে । তখন পাঠক ও লেখক উভয়ের জন্যই তা সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেই লেখার মাধ্যমে পাঠকের কোন ফায়দা হয় না তাই তা থেকে লেখকের উদ্দেশ্যও হাসিল হয় না।
ফাজায়েলে ছাদাকাত মাসআলার কিতাব হিসেবে লেখা হয় নাই। তাই তা থেকে কোন মাসআলার ব্যাখ্যা চাওয়াও ঠিকনা। এটা যে উদ্দেশ্য সামনে রেখে লেখা হয়েছে, সে উদ্দেশ্যেই পাঠ করা উচিত। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে সহীহ বুঝ দান করুন। আমীন।
শরয়ী দলীল
عن أم عطية الأنصارية رضي الله عنها، قالت: دخل علينا رسول الله صلى الله عليه وسلم حين توفيت ابنته، فقال: «اغسلنها ثلاثا، أو خمسا، أو أكثر من ذلك إن رأيتن ذلك، بماء وسدر، واجعلن في الآخرة كافورا – أو شيئا من كافور – فإذا فرغتن فآذنني»، فلما فرغنا آذناه [ص:74]، فأعطانا حقوه، فقال: «أشعرنها إياه» تعني إزاره- روه البخاري في صحيحيه / رقم 1180، ومسلم / رقم939،
وفي فتح الباري لابن حجر (3/ 129 (قيل الحكمة في تأخير الإزار معه إلى أن يفرغن من الغسل ولم يناولهن إياه أولا ليكون قريب العهد من جسده الكريم حتى لا يكون بين انتقاله من جسده إلى جسدها فاصل وهو أصل في التبرك
প্রামাণ্য গ্রন্থাবলীঃ
১। সহীহ বুখারী হাদীস নং ১১৮০
২। সহীহ মুসলিম হাদীস নং ৯৩৯
৩। সুনানে নাসায়ী হাদীস নং ১৮৮১
৪। সুনানে আবু দাউদ হাদীস নং ৩১৪২
৫। সুনানে তিরমিযী হাদীস নং ৯৯০
৬। সুনানে ইবনে মাজা হাদীস নং ১৪৫৮
৭। ফাতহুল বারী ৩/১২৯
৭। উমদাতুল কারী ৮/৪১
৮।শরহে নববী আলা মুসলিম ৭/৩
৯। নাইলুল আউতার ৪/৪০
১০। আউনুল মা’বূদ ১/৫২
১১। বেহেশতী জেওর ১১১
১২। ফাযায়েলে সাদাকাত ৪২২-৪২৫
والله أعلم بالصواب
উত্তর প্রদানে.
মাওলানা মুহাম্মাদ আরমান সাদিক.
ইফতা বিভাগ.
জামিয়াতুল আসআদ আল ইসলামিয়া.
সার্বিক তত্তাবধানে
মুফতী হাফীজুদ্দীন দা. বা.
প্রধান মুফতী
জামিয়াতুল আসআদ আল ইসলামিয়া
ইমেইল-jamiatulasad@gmail.com