যিয়ারাতুল আকাবির, অসুস্থ মুরব্বীদের সান্নিধ্যে (১ম কিস্তি)
-মুফতী আতাউস সামাদ দা.বা.
আল্লাহ রব্বুল আলামীনের মেহেরবানীতে আমরা জামিয়াতুল আসআদ পরিবার প্রতিনিয়ত কিছু নূরানী ও রূহানী কাজ করে থাকি । এবং তা কিছুটা নতুন আঙ্গিকে । সে হিসেবেই আমরা বর্তমান বয়স্ক আকাবিরদের যিয়ারতের ফিকির করেছিলাম এবং এই সামান্য ফিকিরের বরকতে আমীরুল উমারা মুফতী আব্দুর রহমান (রহ.) এর মৃত্যুর সপ্তাহ দু’য়েক আগে যিয়ারত লাভের সুযোগ হয় । বস্তুত এই নুরানী ফিকিরের তাগিদেই আমরা প্রিয় উস্তাদ (মাওলানা হাফীজুদ্দীন দাঃবাঃ, মাওলানা মোস্তফা কামাল, মাওলানা আবদুর রশীদ ও আমি ) গতকাল বাদ ফজর প্রাইভেটকার যোগে কামরাঙ্গীরচরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম । হুজুর আমাকে এ মুবারক যিয়ারতের রাহবার বানালেও কারটি কাকরাইল দিয়ে অতিক্রম করায় কাকরাইল থেকে লালবাগ পর্যন্ত রাস্তাটা অনেকটাই অপরিচিত ছিল, যার কারণে ড্রাইভার মাঝেমধ্যে রাস্তা জিজ্ঞাসা করলে অবুঝের মত ধরণা করে বলতাম । তাই স্বাভাবিক ভাবে লালবাগ দিয়ে না গিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে দিয়ে আমাদের যেতে হলো । এতে কিছুটা সময় লাগলেও এই প্রথম কেন্দ্রীয় কারাগার দেখার সুযোগ পেলাম । কিছুক্ষণ পর জামিয়া দারুল কুরআন লালবাগে হাযির হলাম এবং মুজাহিদে মিল্লাত মুফতী ফজলুল হক আমীনী রহ. এর কবর যিয়ারত করলাম । এখানে মজার ব্যাপার হলো, হযরত (রহ.) কবরের উপর তরতাজা দুটি পেপে গাছ দন্ডায়মান দেখতে পেলাম যার সাথে মুজাহিদে মিল্লাতের অটুট মোজাহাদানা যিন্দেগীর সাদৃশ্যতা মনে হলো যেন গাছ দুটি আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে যে, হে যিয়ারতকারী ! নিজের কর্তব্য পালনে ও বাতিলের বিরুদ্ধে এমনই অটুট থাকতে হয় যেমন কবরে শায়িত মুজাহিদে মিল্লাত ছিলেন ও আমিও যেমন আছি । যিয়ারত শেষে মাওলানা আব্দুর রশীদ ভাইয়ের মাধ্যমে ময়মনসিংহের কৃতিসন্তান মুফতী তাইয়্যেব দাঃবাঃ এর সাক্ষাত হলো, উনার সাথে সালাম, মুআনাকা ও কুশল বিনিময়ের পর কামরাঙ্গীরচরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম । কামরাঙ্গীরচর ব্রীজের চিরাচরিত জ্যাম না থাকায় খুবই অল্প সময়ে জামিয়া নূরিয়ায় হাযির হলাম । প্রথমেই হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) এর কবর যিয়ারত করলাম ও এই মুবারক যিয়ারতের মাধ্যমে অশান্ত মনকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম । কিন্তু কথা হল,
و ما توفيقي إلا بالله
তাই আল্লাহ রব্বুল আলামীন যাকে যতটুকু তাওফীক দিবেন সে আকাবীরের রূহানিয়াত থেকে ততটুকু উপকৃত হবে ।
[এখানে একটি বিষয় উল্লেক্ষ করা প্রয়োজন মনে করছি যে, “মাকবারায়ে হাফেজ্জী হুজুর রহ.” নেম প্লেটের বরাবর কবরটি হলো হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) এর কবর, উনার পিছনের কবরটি একজন আফগান শহীদের যিনি হযরত (রহ.) এর নাতী ও শাহ আহমদুল্লাহ আশরাফ দা.বা. এর ছেলে । এই মকবুল শহীদের কবরের পাশে আরেক শহীদ উবায়দুল্লাহ ইবনে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) এর কবর, যিনি পাকিস্তানে বিমান ট্রানজিটের সময় বিমান বিস্ফোরণে শহীদ হয়েছেন ।]
এরপর নূরীয়ার নতুন ভবনের দ্বিতীয় ফ্লোরে কিছুক্ষণ বসে আমীরে শরীয়ত শাহ আহমদুল্লাহ আশরাফ সাহেবের সাথে দেখা করতে গেলাম । দেখলাম সে হযরত কথা বলতে পারেন না ও কাউকে চিনতে পারেন না । কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে ফিসফিস করে দু একটা কথা বলেন, যা মুখের সাথে কান লাগিয়ে বুঝতে হয় । আমরা যতক্ষণ ছিলাম হযরত বসা ছিলেন ও হযরতের শরীর বারবার পিছনের দিকে নুয়ে যাচ্ছিল আর ছাত্ররা পিঠ ধরে রাখছিল । এসত্ত্বেও হযরত তার মায়াবী চোখে বারবার আমাদের দিকে তাকাচ্ছিলেন ,দৃস্টি নিম্নদিক করছিলেন ও আমাদের দিকে মেলতে ছিলেন এবং হযরতের কানে কানে মুসাফাহার কথা বলার পর হযরত কষ্ট করে একটু হাত বাড়ালেন, এসুযোগে মাওলানা হাফীজুদ্দীন সাহেব হুজুর মুসাফাহা করলেন । এরপরই হাত গুটিয়ে নিলেন । তবুও বরকতের জন্য নিজে থেকেই হযরতের হাতের সাথে আমার হাত মিলিয়ে দিলাম । হযরতের সুস্থতা কামনায় সাতবার أسأل الله العظيم رب العرش العظيم أن يشفيك পড়লাম আর মাওলানা মোস্তফা কামাল প্রতিবার আমীন বললো । সেখান থেকে নূরীয়ার মসজিদের দ্বিতীয় তলায় মু’আল্লিম কোর্স সমাপণকারীদের উদ্দেশ্যে আমাদের ছাত্র মাওলানা উসমানের বড় ভাইয়ের অনুরোধে ২৯ মিনিটের মত বয়ান করলেন; বয়ানে কুরআন ও কুরআনের বাহকদের মর্যাদা তুলে ধরলেন । বয়ান শেষে নাস্তার আয়োজন ছিলো, নাস্তা সেরে মাওলানা হাফীজুদ্দীন সাহেবের সহপাঠী মাওলানা ইলিয়াস সাহেবের রাহবারীতে শাইখুল হাদীস ও আরেফ বিল্লাহ হযরত মাওলানা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী দা.বা. এর যিয়ারতের জন্য উনার বাসায় হাযির হলাম । হযরত দাঃবাঃ দীর্ঘদিন যাবত সহীহুল বুখারীর ২য় খন্ডের দরস দিয়ে আসছেন । হযরতের ইলমী মাকার অনেক উচু পর্যায়ের এবং হযরত দা.বা. হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর জামাতা এবং তিনি হাফেজ্জী হুজুরের কাছে তাসাউফের মেহনত করেছেন । পাহাড়পুরী হুজুরকে হাফেজ্জী হুজুর কখোনো কোনো রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করতে দিতেন না । এখান থেকে আমাদের আলেমদের অনেক কিছুই শেখার রয়েছে । আমরা কোন দ্বীনি ফিকর বুঝে ফেললে আমাদের শাগরিদদের তা করতে বাধ্য করি, যদিও সে অন্য কোন জরুরী দ্বীনী মেহনতে মশগুল থাকে । আল্লাহ আমাদেরকে ভারসাম্যতা দান করুন । আমীন ।
যাই হোক, আমরা দেখলাম হুজুরের বাসাতেই হসপিটালের বেডের ব্যবস্থা আছে, হুযুর তাতে শুয়ে আছেন ও সাথে ক্যাথেটার লাগানো যেমন দেখেছি মুফতি আব্দুর রহমান রহ. কে শুয়ে থাকতে । হুযুরের ছেলে মাওলানা আবরার সাহেব পানি দিয়ে চেহারা মুছে দিলেন এর পর হুজুর আমাদের দিকে লম্বা দৃষ্টি দিচ্ছেন আর মাঝেমধ্যে চোখ বন্ধ করছেন । এভাবেই ছিলো কিছু সময় । এরপর হযরত চোখ বন্ধ করলেন, তখন মাওলানা হাফীজুদ্দীন সাহেব হুজুর পাহাড়পুরী হুজুরের মাথায় একবার হাত বুলিয়ে দিলেন । আমিও এই সুযোগে কয়েকবার হযরতের মাথায় হাত বুলালাম এবং অনেকটা তৃপ্তি বোধ করলাম এই ভেবে যে, হযরত সুস্থ থাকা অবস্থায় হযরতের বরকতী মাথায় হাত রেখে খেদমত না করতে পারলেও আজ আল্লাহ মেহেরবাণী করে এতটুকু খেদমত করার সুযোগ দিলেন । আলহামদুলিল্লাহ ! আরো দেখলাম, হযরত এখন কাউকে চিনেন না ও কথা বলতে পারেন না । আমাদের ছাত্র উসমানের ভাই নিজের পরিচয় দিলেও তার দিকে ফিরে তাকালেন না। হযরতের ছেলে মাওলানা আবরার সাহেবের থেকে জানতে পারলাম যে, হযরত গতবছর বুখারীর সবক পড়াতে পারেননি । একবার ব্রেন ষ্ট্রোকও হয়েছে ও গত রমজান থেকে কথা বলতে পারেন না । বিষণ্ণ মনে হযরতের বাসা থেকে বেরিয়ে আসলাম । এরপর বুড়িগঙ্গা নদী সংলগ্ন বাস্তার পাশে ১২০X২০ বর্গফুট জমিতে টিনসেট বিল্ডিং জুড়ে নূরীয়ার বিশাল মক্তব বিভাগ । এর জিম্মাদারীতে রয়েছেন উসমানের ভাই মাওলানা আবু বকর সাহেব । বেশ রসিক ও উদ্যমী মনে হলো, তিনি নূরানী বোর্ডের কার্যক্রম শুনালেন ও কিছু কারগুযারীও শুনালেন এবং মাওলানা হাফীজুদ্দীন সাহেব হুজুরকে হাফেজ্জী হুজুরের নামের সাথে মিল রেখে লেখা “হাফেজী নূরানী কায়েদা” এর দুই কপি হাদিয়া দিলেন । তার কথাশুনে বেশ ভালোই লাগছিলো । এই নূরানী মক্তব বিভাগের সাথেই হলো হাফেজ্জী হুজুরের স্মৃতি বিজাড়িত বিশাল পুকুর, যা এখন ভরাট করে কিছু কারখানা বানানো হয়েছে । মাওলানা হাফীজুদ্দীন সাহেব নূরীয়ায় এসেছেন খবর পেয়ে মাওলানা ফখরুল ভাইয়ের শ্বশুর ও হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর নাতিন জামাই মাওলানা আব্দুল্লাহ সাহেব আমাদেরকে তার বাসায় নিয়ে গেলেন, অনেক মেহমানদারি করলেন । উনার বাসা আমাদেরকে দেখালেন । আরো দেখালেন যে, উনার বাসার একটা ফ্লোর শুধুমাত্র উলামায়ে কেরামের ইজতেমার জন্য বরাদ্ধ করেছেন এবং মাওলানা হাফীজুদ্দীন সাহেবকে বললেন, আপনি যেদিন ইচ্ছা করবেন সেদিনই কামরাঙ্গীরচরের সকল উলামায়ে কেরামকে দাওয়াত দিয়ে ইসলাহী প্রোগ্রামের আয়োজন হবে । এবার আমরা ছুটলাম হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর খলীফা, চকবাজার শাহী মসজীদের খতীব মাওলানা ক্বারী উবায়দুল্লাহ দা.বা. এর সাক্ষাতের জন্য । এখানেও আমাদের রাহবার মাওলানা ইলিয়াস সাহেব । কামরাঙ্গীরচর পুরানো পরিচিত হলেও কারী সাহেব দা.বা. এর বাড়ি পরিচিত ছিল না । আর আমাদের রাহবারের কাছে অনেকটা পরিচিত থাকলেও উনাকেও কিছুটা বেগ পেতে হলো । মাওলানা ক্বারী উবায়দুল্লাহ সাহেব চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার কোদালা গ্রামে ১৯৪৪ সানের ১লা জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন । উনার পিতা মাওলানা মাহারুজ্জামান ইসলামাবাদী রহ. পটিয়া মাদ্রাসার বানী মাওলানা আজিজুল হক রহ. ওর খলীফা ছিলেন । উস্তাদ-শাগরিদ তাসাউফের মেহনতে একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করতেন । ১৯৬২ সনে লালবাগ মাদ্রাসা থেকে মাওলানা পাশ করে চকবাজার শাহী মসজিদে খতীবের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন । ২০০৬ সাল থেকে অসুস্থ থাকার কারণে জুমার নামায আদায় করতে পারছেন না । কারী সাহেবের তেলাওয়াত ও আযান এদেশের বিভিন্ন ইলেক্ট্রিক মিডিয়ায় দৈনিক প্রচারিত হয়ে থাকে । বাংলাদেশ পার্লামেন্টের ১ম অধিবেশন থেকে ৯ম পার্লামেন্ট পর্যন্ত জাতীয় সংসদকে কোরআনের মধুর সুরে মুখরিত করে রেখেছিলেন, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, নিউ মার্কেট, হোটেল শেরাটনসহ জাতীয় অসংখ্য স্থাপনার উদ্বোধন হয়েছে তার তেলাওয়াতের মাধ্যমে এবং সৌদি আরব, কাতার, দুবাই, লিবিয়া, বাহরাইন, সিঙ্গাপুর, মালায়শিয়া, পাকিস্তান সহ বিশ্বের অন্তত ২০-২৫ টি দেশে আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় বারবার ১ম স্থান অর্জন করেন ও বাদশাহ ফয়সাল ও খলিফা থেকে কারী হিসেবে বিশেষ সম্মাননা প্রাপ্ত হন । এমন বিরল প্রতিভার মানুষটি এ পর্যন্ত ২০০০,২০০৬,২০০৮,২০০৯,২০১০ ও ২০১২ সালে মোট ছয়বার ব্রেনষ্ট্রোক করেছেন ।
আমরা এমনই এক বড় ব্যক্তির যিয়ারতের জন্য হাযির হলাম । ক্বারী সাহেব যে বাড়ীতে থাকেন সে বাড়ীর ২য় তলায় গেলাম আর তখন মক্তবের শিশুরা সবক শেষে চলে যাচ্ছিলেন । আমরা রুমে বসে ক্বারী সাহেবের অপেক্ষায় রইলাম । যে রুমে বসলাম তা বিল্ডিং এর হালও খুবই শোচনীয়; রুমের উত্তর দিকে একটি আলমারী ও অনেক পুরনো মিরছপ, আরেক পাশে সাদামাটা খাট, পাশে মাদ্রাসার পরিবেশের যত জিনিসপত্র ও কাপড় চোপড় রাখা আর রুমের দক্ষিণ দিকে একটি সেলফ তাতে অনেক পুরনো কিতাব আছে । এর পাশে একটি হুইল চেয়ার অপর পাশে আরেক বুক সেলফে কিছু নতুন কিতাব দেখা যাচ্ছিল আর যে দরজা দিয়ে ঢুকেছি সে দরজার পাশে আরেকটি বুক সেলফ তাতেও বেশ পুরনো কিতাব আর রুমের মাঝে ক্বারী সাহেবের বসার জন্য সাদামাটা গদির চেয়ার, সাথে একটি কাঠের লাঠি রাখা । এই হলো আন্তর্যাতিক পর্যায়ের ক্বারী সাহেবের বাড়ির অবস্থা; নেই কোন আরামের গদি, সোফা, এসি, সুসজ্জিত কক্ষ বা আয়েশী কোন উপকরণ । অথচ এমন মুখলুছ কারী সাহেবদের কুরআন চর্চার বরকতেই আল্লাহ এই দেশকে, এই পৃথিবীকে টিকিয়ে রেখেছেন । এমন ব্যক্তিরা না থাকলে বাংলাদেশ বহু আগেই খোদার গযবে ধসে যাওয়ার কথা ছিল । আমরা তখন কথা বলছিলাম কারী সাহেবের ছাত্র মাওলানা বদরুল সাহেবের সাথে (বাড়ি নরসিংদী) তিনি ক্বারী সাহেবের বাবার বুযুর্গীর কথা শুনাচ্ছিলেন, আমরা “আল মাদ্রাসাতুল মেহেরিয়া মাঈনুল ইসলাম ও এতিমখানা সফরমাটা, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম” নামে এক বড় মাদ্রাসার ক্যালেন্ডার দেখছিলাম; উনি বললেন যে, এটা কারী সাহেবের বাবার প্রতিষ্ঠিত ও বর্তমানে তা আরো বড় । আরো কথা হচ্ছিল যে, কারী সাহেবের ঢাকায় কোন সম্পত্তি নেই । এখন আমরা যেখানে বসলাম এটা কারী সাহেবের শাশুড়ির জমিতে নির্মিত বাড়ি এবং এখানে যে মক্তব দেখা গেলো তাও কারী সাহেবের শাশুড়ির নাম হিসেবে “আক্তার বানু-পারভেজ হায়দার নূরানী মাদ্রাসা” নামকরণ করা হয়েছে । কিছুক্ষণ পর কারী সাহেব হেটে হেটে আসলেন । সুষ্পষ্টই বুঝা যাচ্ছিল যে, উনার হাটতে কষ্ট হচ্ছে । মাওলানা বদরুল সাহেব কারী সাহেবকে গদিতে বসতে বললেও কষ্ট করে নিচু-খাটে বসলেন আর আমিও উনার সামনে মেঝেতে বসলাম । দেখলাম কারী সাহেব কথা বলতে পারেন না তবে স্মৃতিশক্তি সচল আছে । মাঝে মধ্যে মুবারক ঠোট দিয়ে লালা আসছে আর কারী সাহেব পুরনো রুমাল দিয়ে লালা মুছছেন । আমিও কয়েকবার যতক্ষণ কারী সাহেবের বাসায় ছিলাম টিস্যু দিয়ে লালা মুছে দিলাম; মাওলানা হাফীজুদ্দীন সাহেব আরো ভালো করে মুছে দিতে বললেন, ঠোটের কোনে খাদ্য কণা লেগেছিল, সেটাও মুছে দিতে বললেন । পাশাপাশি উনার বামহাত অবশ হয়ে গেছে । খাটে বসার পর খাট থেকে দুই তিন হাত দূরে রাখা কার্টুনের দিকে ইশারা করে মাওলানা বদরুল সাহেবকে দিতে বললেন । কারী সাহেব কার্টুন থেকে কাগজের মধ্য থেকে খোজে খোজে আতরের শিশি বের করলেন, সবাইকে এক শিশি করে আতর দিলেন, আমাকেও গোলাপী রঙ্গের খাপে ঢুকানো ও গোলাপী রঙ্গের জরি এটে দেওয়া কাচের শিশিতে ভরা আতর দিলেন । আমি কারী সাহেবের দুই হাতে ও কোর্তায় আতর লাগিয়ে দিলাম । কারী সাহেবের গায়ে সুন্দর কোনো জামা ছিল না গায়ে যে পাঞ্জাবী ছিল, তাতে পিক লাগা ছিল । কি করুণ অবস্থা ! আমি একটি কাগজ (যার অপর পৃষ্ঠায় উনার ব্যাপারে ছাপা কোন পত্রিকার আর্টিকেলের ফটোকপি ছিল ) দিলাম ও বাম হাতে কলম দিলাম যে, আমাদের জন্য কিছু নসীহত লেখে দিন । কারী সাহেব আমাদের জন্য কলম দিয়ে কিছু লেখতে শুরু করেও কোন শব্দ লেখলেন না ; তার কাগজে কলমের দাগ রয়েছে । লেখা শুরু করার সময় উনার মনে পড়ল যে, উনার লেখা আমলের কিছু কথা কোন এক কাগজে লেখা আছে; তাই কার্টুনে আবার কাগজ খুজতে লাগলেন । খুজে খুজে আমলের দুটি কাগজ আমাকে দিলেন, যাতে মকসুদ পুরা হওয়ার আমল ও মুছীবত দেখার সময় আমল লেখা ছিল । উনি ইশারায় হাতের কড়া গুনে গুনে আমল করতে বলছিলেন । এর মধ্যে একটা আমল ছিলো কুরআনের এই আয়াত দিয়ে যা হস্ত লিখিত ছিলো –
فسيكفيكهم الله و هو السميع العليم
আমি এই আয়াত কারী সাহেবের সামনে পড়তেই কারী সাহেব শিশুর মত কাঁদতে শুরু করলেন । আমি মাওলানা হাফীজুদ্দীন সাহেবের পরিচয় দিলাম যে, উনি আসআদ মাদানী রহ. এর খলীফা । একথা শুনে হুজুরের দিকে হাত দ্বারা ইশারা করে দুআ চাইলেন । এরপর কারী সাহেবের সুস্থতার জন্য হুজুর দুআ করলেন আর কারী সাহেব শিশুর মত কাদতে থাকলেন । আমাদের চলে আসার আগে মাওলানা হাফীজুদ্দীন সাহেব মাথা বাড়িয়ে মাথায় হাত রাখলেন, অন্যদেরকেও আদর করলেন, আমাকে একটু বেশী আদর করলেন । আমরা সেখান থেকে মাদরাসাতুল মদীনায় আসলাম, নদবী সাহেব হুজুরের সাথে দেখা হলো । আমাদের উদ্দেশ্য ছিল আদীব হুজুরের সাথে সাক্ষাৎ করা । কারণ, আদীব হুজুর অনেক দিন যাবত অসুস্থ, মাঝে কিছুদিন আইসিও তে ছিলেন । কিন্তু হুজুর অসুস্থ হওয়ার পর থেকে সারা রাত কাজ করে বাদ ফজর নাস্তা খেয়ে ঘুমিয়ে যান আর শরীর অনেক খারাপ থাকায় এভাবে দুপুর বারটা, একটা পর্যন্ত ঘুমান । এমনটাই জানা গেছে নদবী সাহেব হুজুরের কাছ থেকে । নদবী সাহেব হুজুর মাওলানা হাফীজুদ্দীন সাহেব হুজুরকে আশ্বাস দিলেন আদীব হুজুরের কাছে সালাম পৌছে দেওয়ার জন্য ।
সেখানে আমরা বুড়িগঙ্গা বেড়িবাঁধ হয়ে গেন্ডারিয়া ডি.আই.টি প্লটে হাযির হলাম মুহিউদ্দীন খান সাহেবের সাক্ষাতের জন্য । তখন বেলা ১টা হয়ে গেছে । খান সাহেব তখন গোসল করছেন বলে জানালো খান সাহেবের খাদেম । খাদেম আমাদেরকে বসতে বলল, আমরা খান সাহেবের সাক্ষাতের আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম । তখন আমরা খান সাহেবের ভবনের নিচ তলায় বসা ছিলাম আর উপভোগ করছিলাম খান-সাহেবের কৃতিত্বপূর্ণ সকল সম্মাননা পুরুস্কারের ক্রেস্টগুলো । অনেক্ষণ পর প্রায় আধা ঘন্টা পর খান সাহেব আমাদেরকে খাদেমের মাধ্যমে ডাকালেন. আমরা ভবনের ২য় তলায় উঠলাম । এই প্রথম দেখলাম খান সাহেবকে । খান সাহেব কথা বলতে পারেন, স্মৃতিশক্তিও ঠিক আছে । উনার সাথে আমাদের সালাম ও মুসাফাহা হলো । আমাদের সবার বাড়ির ঠিকানা জিজ্ঞেস করলেন । আমাকে জিজ্ঞাস করলে বললাম, টাঙ্গাইল, মধুপুরের পরের ধনবাড়ী উপজেলা । খান সাহেব বললেন, ধনবাড়ী তো আমি চিনি । মাওলানা হাফীজুদ্দীন সাহেব হুজুরকে জিজ্ঞেস করলে হুজুর বললেন, মুন্সিগঞ্জ । আবার জিজ্ঞাস করলেন মুন্সিগঞ্জের কোন থানা ? হুজুর বললেন, সিরাজদিখান । খান সাহেব বললেন, আমরা যখন আপনাদের মত ছিলাম তখন মুন্সীগঞ্জের কেউ আলেম হবে একথাও কল্পনাও করতে পারতাম না । খান সাহেব হুজুরকে জিজ্ঞেস করলেন, কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ সাহেবের পর কে মালিবাগের মুহতামিম ? হুজুর বললেন, কুমিল্লার আশরাফ আলী সাহেব সপ্তাহে একদিন আসেন । খান সাহেব বললেন, তাতেকি হয় ? মাওলানা হাফীজুদ্দীন সাহেব বললেন, কাজী সাহেব হুজুর আমাদেরকে যে নেযামে উঠিয়ে গেছেন আমরা তার উপর আছি ।
[উপভোগ করছিলাম খান-সাহেবের কৃতিত্বপূর্ণ সকল সম্মাননা পুরুস্কারের ক্রেস্টগুলো]
খান সাহেব হুজুর বললেন, আপনার সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য আসলাম । খান সাহেব বললেন, এখন তো সৌজন্য সাক্ষাত করলেও রিপোর্ট হয় যে, হুজুররা মিটিং করেছে । খান সাহেব দৈনিক পত্রিকার হেড লাইন দেখালেন যে, প্যারিসে হামলা হয়েছে এবং বললেন, এটা আমাদের জন্য দুঃসংবাদ ।
খান সাহেব বললেন, আমি ঢাকা আলিয়াতে পড়তাম, এখন ঢাকা আলিয়ার যে অবস্থা আমাদের সময় এমন অবস্থা ছিলো না । যফর আহমদ উসমানী রহ. এর কাছে বুখারী শরীফ পড়েছি । দুপুরে ঢাকা আলিয়া থেকে শামসুল হক ফরিদপুরী সাহেবের কাছে বসতাম, এরপর পীরজী হুজুরের কাছে বসতাম আর মাগরিব পড়তাম মুফতী আমীনুল ইহসান সাহেবের পিছনে, মাগরিবের পর আমিমুল ইহসান সাহেব একটি হাদীস নিয়ে আলোচনা করতেন । বর্তমানে উনাদের মাপের একজন আলেমও নেই । মুসাফাহা করে যখন খান সাহেবের থেকে চলে আসছিলাম তখন খান সাহেব আমাদেরকে থামিয়ে দিলেন এবং হাজরে আসওয়াদের কাবার ছবি লাগানো আতর আমাদেরকে সবার হাতে যত্নের সাথে নিজ হাতে মেখে দিলেন । এরপর ডি.আই.টি প্লটের জামে মসজিদে জোহরের নামায আদায় করে মাদ্রাসায় চলে আসলাম ।
আল্লাহ রব্বুল আলামীন আমাদের সবাইকে আকাবিরদের সঠিক স্থলাভিষিক্ত হিসেবে গ্রহণ করুন এবং আমাদের সবাইকে আকাবিরের সোহবত লাভের ও স্মৃতিচারণ থেকে নেক যিন্দেগী গঠনের জযবা দান করুন । আমীন ।
1 Response
[…] […]