যিয়ারাতুল আকাবির, অসুস্থ মুরব্বীদের সান্নিধ্যে (২য় কিস্তি)
-মুহাম্মাদ আরমান সাদিক
১৭ই নভেম্বর, মঙ্গলবার, বাদ আছর । মুফতী হাফীজুদ্দীন সাহেব, আমি ও মাওলানা আলতাফ ভাই। সি.এন.জি’র খোঁজে ওয়াপদা রোডের মাথায় অপেক্ষা করছি। গন্তব্য নতুন বাজার ওয়াসা রোড। আল্লামা ফরিদ উদ্দীন মাসউদ দা.বা. এর বাসায়। বেশ ক’দিন যাবত তিনি অসুস্থ। হার্টের সমস্যা। তিন সপ্তাহ হল বাসাতেই অবস্থান করছেন। কোথাও বের হওয়া নিষেধ। ডাক্তার তাকে পুরোপুরি রেষ্টে থাকতে বলেছেন। ফরিদ সাহেবের যিয়ারতের উদ্দেশ্যেই আমাদের আজকের সফর। মাগরিবের নামাজটা তার বাসার কাছাকাছি কোন মসজিদে আদায় করার ইচ্ছা। ঢাকার ব্যস্ত জনপদে ব্যস্ত সময়ে কপালে কোন সি.এন.জি জুটলো না। শেষ পর্যন্ত রিক্সা-ই ভরসা। দু’টি রিক্সা নিয়ে (আলহামদুলিল্লাহ) মাগরিবের আজান হচ্ছে এমন সময় ওয়াসা রোডে পৌঁছে গেলাম। কোন মসজিদে নয়, ওয়াসার ভেতর নির্ধারিত নামাযের স্থানে জামাতে নামায আদায় করে নিলাম। একটা বিষয়ে মনে খুব ব্যাথা পেলাম। মসজিদের শহর ঢাকা। অথচ ঢাকার অত্যন্ত উন্নত ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় এক বারিধারা মাদরাসা-মসজিদ ছাড়া অন্য কোন মসজিদ নেই।
মাগরিবের নামায আদায় করে দারোয়ানের কাছে নাম-ঠিকানা লিখিয়ে দু’তলায় বৈঠক খানায় গিয়ে বসলাম। তখন তার ছেলে মাওলানা জুনুদ (বর্তমানে এল.এল.বি অধ্যায়নরত) বাসায় ছিলেন। তিনি আমাদেরকে তার বাবার বর্তমান শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে যা জানালেন, তা এরকম- ফরিদ সাহেব ‘রাশিয়া’ সফর থেকে ফেরার পথে বিমানে থাকা অবস্থায় বুকে চাপ অনুভব করেন। সেখানে হার্ট এর রোগীদের জন্য রাখা বিশেষ স্প্রে প্রয়োগ করার পর সমস্যাটা কেটে যায়। বাংলাদেশে পৌঁছে বঙ্গবন্ধু হাসপাতালের ডি.সি কে বিষয়টি জানানোর পর তিনি তার হাসপাতালে শরীর চেক-আপ করাতে অনুরোধ করেন। প্রথমে ই.সি.জি করার পর কোন সমস্যা ধরা না পরায় এন.জি.ও গ্রাম করতে বলেন। এন.জি.ও গ্রাম করার পর দেখা যায়, ফরিদ সাহেবের একটি রগ পুরোপুরি ব্লক হয়ে গেছে। আর কিছু রগ আংশিক ব্লক। যেটা হার্ট এর রোগ হিসেবে অনেক বড় সমস্যা হবার কথা ছিলো। কিন্তু কুদরতিভাবে আল্লাহ্ তাআলা রক্ত চলাচলের বিকল্প মাধ্যম তৈরী করে দিয়েছেন। এই বিকল্প ব্যবস্থা না হলে বড় ধরনের অপারেশন করতে হতো। ডাক্তার এর ভাষায়: “এরকম খুব কমই ঘটে থাকে। যেহেতু বিকল্প ব্যবস্থা আছে তাই তার রোগ কিছুটা আশংকা মুক্ত। তবে এখন পুরোপুরি রেষ্টে থাকতে হবে।” তার কথার মাঝখানেই ফরিদ সাহেব আমাদের মাঝে উপস্থিত হলেন। আমরা সবাই উঠে তার সাথে সালাম-মুসাফাহা করলাম। এখানে ফরিদ সাহেবের পরিচয়টা দিয়ে নেই।
“আল্লামা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় একজন আলেম। লেখক, গবেষক, কথা সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, সফল অনুবাদক ও ইসলামি চিন্তাবিদ। তার বহু গ্রন্থ ও প্রবন্ধ পাঠক মহলে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে ও বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে। তিনি ফিদায়ে মিল্লাত সায়্যেদ আস’আদ মাদানী রহ. এর বিশিষ্ট খলিফা। দারুল উলুম দেওন্দের কৃতি সন্তান। বহু বছর যাবত বিভিন্ন মাদরাসায় বুখারী শরীফের র্দস দিচ্ছেন। যার ফলে তার বহু ছাত্র দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। বর্তমানে তিনি তার প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা ‘জামিয়া ইকরা বাংলাদেশ’ এর মুহতামিম ও শাইখুল হাদীস পদে আছেন। উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ ইদগাহ- শোলাকিয়া ময়দানে ঈদের নামাযের ইমাম। মাসিক পাথেয় এর প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক। তিনি দীর্ঘদিন যাবত ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের পরিচালক পদে দায়িত্বরত ছিলেন। ৭০ দশকের আলেম প্রজন্মের চেতনাদ্ভূত সংগঠন “লাজনাতুত তোলাবা”র প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। বর্তমানে সেই লাজনা’র ফসলের হাতেই ইসলামি সাহিত্যাংগনের ঝান্ডার নেতৃত্ব রয়েছে।
উলামায়ে বংলাদেশের প্রচলিত ধারার মতাদর্শ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রাখার কারণে বারংবার তাকে সমালোচিত হতে হয়েছে। কিন্তু তার মেধা ও খেদমতের সামনে সমালোচনার অবস্থান সবসময়ই থেকেছে অপ্রতুল। তার ঘোর সমালোচকরাও তার ইলম ও প্রজ্ঞাকে শ্রদ্ধার চোখেই দেখে। আল্লাহ তাআলা আমাদের উপর তার ছায়াকে আরোও সম্প্রসারিত করুন। আমীন।
ফরিদ সাহেব প্রথমেই হাফীজুদ্দীন সাহেবের হাল-পুরসি করলেন। হুজুরের সন্তানেরা কে কি করে জিজ্ঞাসা করলেন। আমরা তার শরীরের অবস্থা জানতে চাইলে বললেন, আল্লাহ তাআলা কুদরতিভাবে হার্টের রক্ত চলাচলের জন্য বাইপাসের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ডাক্তাররা বললো, আপনার প্রতি ভক্তদের যে দোয়া আছে, তারই ফলশ্রুতিতে এটা হয়েছে। তিনি বলেন, দেখো! দোয়া হল মানুষের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। দোয়া দিয়ে অনেক অসম্ভব জিনিসও সম্ভব করা যায়। অথচ মানুষ এটা অনুধাবন করতে পারে না।
এরপর রাশিয়ার সফরের ব্যপারে বলেন, রাশিয়াতে আমাদের যে বাড়িতে থাকতে দেয়া হয়েছিলো তা ছিলো এককালীন রাশিয়ার শাসক ষ্টেলিনের। ষ্টেলিনের নাম তো শুনেছ। সে ছিল কমিউনিষ্ট, নাস্তিক। দেখো! জীবনে যে স্থানে আল্লাহর সেজদা পড়েনি আল্লাহ তাআলা সেখানে সেজদা পড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
ফরিদ সাহেব হার্ট এর রোগের ব্যপারে আশ্চর্য এক গবেষণার কথা শোনালেন। তিনি বলেন, ইন্ডিয়ার এক বিজ্ঞানী ডাক্তার হার্টের রোগ কি কারণে হয় তার গবেষণা চালালো। সে দেখলো, ইন্ডিয়ার ইউ.পি তে লোকজনের হার্টের রোগ সবচেয়ে কম হয় আর দক্ষিণের লোকদের হয় বেশী । তাদের খাদ্য অভ্যাসে দেখা গেল ইউ.পি’র লোক আমিষ ভোজী। মাংস বেশী খায়। আর দক্ষিণের লোকজন ভেজিটেরিয়ান মানে নিরামিশ ভোজী। শাক-সবজী বেশী খায়। যারা মাংস খায় এদের হার্টের রোগ কম, আর যারা সবজী খায় তাদের বেশী। সে আরো গবেষণা চালিয়ে দেখলো, যারা নিরামিশ খায় তার তেল, ঘি বেশী খায়। আর যারা মাংশ খায়, তারা তেল কম খায়। তাহলে তেল-চর্বিই হার্টের রোগের জন্য দায়ী হল।
এরপর সেই গবেষক তার গবেষণার কাজকে আরো ব্যাপক করলো। দেখলো, বিশ্বে সবচেয়ে বেশী তেল-চর্বি খায় কারা? দেখা গেল, আরবরা সবচেয়ে বেশী তেল-চর্বি খায়। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হল, পৃথিবীতে আরবদের হার্টের রোগ সবচে’ কম হয়। তাদের মাঝে যারা তেল-চর্বি বেশী খায়, তাদের হার্টের রোগের হার আরোও কম।
এখন বুঝা গেল, হার্টের রোগের জন্য তেল-চর্বিও দায়ী নয়। তাহলে কেন হার্টের রোগ হয়? এরপর সে অনেক গবেষণা চালানোর পর তার কাছে যে ফলাফল আসল তা হল, মায়ের গর্ভে থাকতেই ঠিক হয়ে যায় কার হার্টের রোগ হবে আর কার হবে না। (সুবহানাল্লাহ!) তার গবেষণা শেষ পর্যন্ত তাকদিরের সত্যতার দিকে নিয়ে গেল।
এরপর ফরিদ সাহেব বলেন, এজন্যই আমি মুক্তমনাদের স্বাগত জানাই। কেউ যদি প্রকৃত মুক্তমনা হয়ে থাকে, মুক্তভাবে চিন্তা-গবেষণা করে, তাহলে তার গবেষণা তাকে ইসলাম পর্যন্ত নিয়ে আসবে। কারণ ইসলাম হল ফাতরাতের ধর্ম। একারণে তাকে ইসলামের দিকেই আসতেই হবে।
আর কেউ যদি ইসলাম পর্যন্ত না পৌঁছে কিংবা ইসলাম থেকে দূরে সরে যায়, তাহলে বুঝতে হবে মুক্তচিন্তার নামে সে অন্যায় কিছু করছে। সে মুক্তমনা না বরং শয়তানমনা। মুক্তমনা হলে ইসলাম পর্যন্ত আসতই। বর্তমানে যারা নিজেদের মুক্তমনা দাবী করে তারা এই শব্দটিকে হাইজাক করেছে। মুক্তমনাতো তারা, যারা কোন প্রভাবে প্রভাবান্বিত না হয়ে মুক্তভাবে চিন্তা করে। সত্যিকার অর্থেই যদি তারা মুক্তমনা হতো, তাহলে তাদের এই চিন্তা নাস্তিকতার দিকে না নিয়ে ইসলামের দিকে নিয়ে যেত।
ফরিদ সাহেবের সাথে কথা বলা অবস্থায়ই আমাদের জন্য নাস্তা নিয়ে আসা হল। ফিরনী, কমলা ও খাঁটি গরুর দুধের চা। তিনি আমাদের নাস্তা গ্রহণ করতে বললেন। বুজুর্গের বাড়ির জিনিস, তাই কোন কিছু খেতে কার্পণ্য করলাম না। তিনিও আমাদের সাথে দু’এক কোয়া কমলা খেয়ে বিদায় নিলেন। আমরা নাস্তার সদব্যবহার করে তার দ্রুত শেফা কামনা করে নিজ নিজ গন্ত্যব্যস্থলে ফিরে আসলাম।