জুম’আ ও ঈদের খুৎবা আরবী হওয়া জরুরী
জুম’আর নামাযের ফরজের পূর্বে এবং ঈদের দু’ রাকাত নামাযের পর খুৎবা দেওয়া জরুরী ও ওয়াজিব। আর মুসল্লীদের জন্য সেই খুৎবা শ্রবণ করাও ওয়াজিব। জনাব রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আমল এবং সাহাবায়ে কেরাম ও পরবর্তী হামেলে দ্বীন বা দ্বীনের ধারক-বাহক হযরত উলামায়ে কেরাম এর উপর আমল করেছেন। এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে কথা হল, খুৎবার ‘ভাষা’ কি হবে?
হাদীস ও ইসলামি ইতিহাস তালাশ করলে দিবালোকের ন্যায় এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হবে যে, খুৎবার ভাষাটি “আরবী” ছিলো, এখনও আরবীতেই হবে। আরবী ছাড়া অন্য ভাষায় খুৎবা দিলে তা হবে সুন্নতপরিপন্থী এবং মাকরূহ। সুতরাং কোন মুসলমানের জন্য উচিৎ নয়, মোবারক এই আমলটিকে মাকরূহযুক্ত করে দেওয়া। এ ব্যাপারে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, খুৎবা এর অর্থ- ভাষণ হলেও এর মাঝে ইবাদাতের অর্থও রয়েছে। এ কারণেই খতীবের জন্য যা যা করণীয়:
ক. খুৎবা এর জন্য নির্দিষ্ট মঞ্চ বা মিম্বার রয়েছে। এই মিম্বারের বাহিরে থেকে খুৎবা দেওয়া যাবে না। (ফতাওয়া শামী: ৩/১৬১)
খ. উভয় খুৎবাতেই আল্লাহর উপর হামদ ও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর দুরূদ, কোরআনের আয়াত ও হাদীস উল্লেখ থাকা জরুরী। (ফাতাওয়া আলমগীরী: ১/১৪৬-১৪৭, ফতাওয়া শামী: ৩/২১)
গ. খুৎবা আরবীতে দিতে হবে। (জাওয়াহিরুল ফিকহ: ১/৩৫২, ফতাওয়া দারুল উলুম: ৫/১২৯)
ঘ. এবং খুৎবা দাড়িয়ে দিতে হবে। বসে দিলে হবে না।
ঙ. খুৎবা দু’টি হতে হবে এবং এর মাঝখানে বসতে হবে। এর ব্যতিক্রম করা যাবে না।
চ. কেবলার দিকে খতীবের পিঠ ও মুসল্লীদের দিকে মুখ থাকা জরুরী। শেষোক্ত তিনটি শর্ত সম্পর্কে হাদীসের কিতাবসমূহে উল্লেখ আছে,
كان النبي صلى اللَّه عليه وسلم يخطب يوم الجمعة خطبتين قائماً يفصل بينهما بجلوس.
অর্থাৎ, হুজুর সা. জুম’আর দিন দাঁড়িয়ে দু’টি খুৎবা পেশ করতেন এবং উভয় খুৎবার মাঝে সামান্য সময় বসতেন।
(মুসনাদুস শাফেঈ: ১/১৪৪, হাদীস নং-৪১৮)
وحدثنا عبيد الله بن عمر القواريري، وأبو كامل الجحدري، جميعا عن خالد، قال أبو كامل: حدثنا خالد بن الحارث، حدثنا عبيد الله، عن نافع، عن ابن عمر، قال: ্রكان رسول الله صلى الله عليه وسلم يخطب يوم الجمعة قائما، ثم يجلس، ثم يقوم.
অর্থাৎ, হযরত ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, হুজুর সা. দাঁড়িয়ে জুম’আর খুৎবা পড়তেন। অতপর সামান্য সময় বসে পুনরায় দাঁড়িয়ে যেতেন। (সহীহ মুসলিম: ২/৫৮৯, হাদীস নং-৮৬১)
حدثنا عبد الله بن محمد، وسمعته أنا منه، قال: حدثنا عبد الرحمن بن محمد المحاربي، عن الحجاج، عن الحكم، عن مقسم، عن ابن عباس، عن النبي صلى الله عليه وسلم: أنه كان ” يخطب يوم الجمعة قائما، ثم يقعد، ثم يقوم فيخطب.
অর্থাৎ, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. জুম’আর খুৎবা সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, হুজুর সা. দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জুম’আর খুৎবা পেশ করতেন। আবার সামান্য সময় বসে পুনারায় দাঁড়িয়ে খুৎবা পড়তেন।
(মুসনাদে আহমাদ: ৪/১৬৫, হাদীস নং-২৩২২)
أخبرنا محمد بن عبد الله بن بزيع، قال: حدثنا يزيد يعني ابن زريع، قال: حدثنا إسرائيل، قال: حدثنا سماك، عن جابر بن سمرة، قال: رأيت رسول الله صلى الله عليه وسلم يخطب يوم الجمعة قائما، ثم يقعد قعدة لا يتكلم، ثم يقوم فيخطب خطبة أخرى، فمن حدثكم أن رسول الله صلى الله عليه وسلم كان يخطب قاعدا فقد كذب.
অর্থাৎ, হযরত জাবের ইবনে সামুরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সা. কে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জুম’আর খুৎবা বয়ান করতে দেখেছি। অতপর তিনি (প্রথম খুৎবা শেষ করে) সামান্য সময় নিশ্চুপ বসে থাকতেন এবং আবার দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় খুৎবা পেশ করতেন। অতএব তোমাদের মধ্য থেকে যে হুজুর সা. সম্পর্কে এ কথা প্রকাশ করবে যে, তিনি বসে খুৎবা দিতেন, তাহলে সে যেন তাঁর সম্পর্কে মিথ্যা বর্ণনা করালো। (নাসাঈ: ৩/১১০, হাদীস নং-১৪১৭)
حَدَّثَنَا قُتَيْبَةُ بْنُ سَعِيدٍ، قَالَ: حَدَّثَنَا إِسْمَاعِيلُ بْنُ جَعْفَرٍ، عَنْ شَرِيكٍ، عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ: أَنَّ رَجُلًا، دَخَلَ المَسْجِدَ يَوْمَ جُمُعَةٍ مِنْ بَابٍ كَانَ نَحْوَ دَارِ القَضَاءِ، وَرَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَائِمٌ يَخْطُبُ، فَاسْتَقْبَلَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَائِمًا.
অর্থাৎ, হযরত আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত, একদা এক ব্যক্তি পূর্বদিনের নির্ধারিত দারুল কাযার দরজা দিয়ে জুম’আর দিন রাসুল সা. এর খুৎবা পড়াকালীন সময় প্রবেশ করলো। অতপর রাসুল সা. এর দিকে মুখ করে-কিবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। (এর দ্বারা প্রতিয়মান হয় যে, খুৎবার সময় হুজুর সা. এর পিঠ মোবারক কিবলার দিকে ছিল এবং তিনিও মুসল্লীদের দিকেই মুখ করে ছিলেন) (সহীহ বুখারী: ২/২৮, হাদীস নং-১০১৪)
সুতরাং উপরোক্ত বর্ণনাসমূহ দ্বারা পরিষ্কার বুঝা গেলো যে, যদি খুৎবা অর্থ কেবল ভাষণ দেওয়াই হতো, তাহলে এসব বিষয় এর বাধ্য-বাধকতা থাকতো না। এসব বিষয়ের বাধ্য-বাধকতা থাকা প্রমাণ করে যে, এটা নিছক ভাষণই নয়, বরং ইবাদাতও বটে! আর ইবাদাতের ক্ষেত্রে ভাষার পরিবর্তন অযৌক্তিক ও নিষিদ্ধ। যেমন, নামাযে কোরআনের তেলাওয়াত হয় আরবীতে, এমতাবস্থায় নামাযী ব্যক্তি ভিন্নভাষী হবার কারণে আরবী না বুঝলেও আরবীতেই নামাজ পড়তে হবে। তেমনিভাবে খুৎবার ক্ষেত্রেও একই হুকুম। আরবী না বুঝলেও খুৎবা আরবীতেই হবে, আরবীতেই পড়তে হবে।
হ্যাঁ, এ ক্ষেত্রে শুধুমাত্র এতোটুকু অবকাশ দেয়া যেতে পারে যে, আগে পরে খুৎবার মর্মার্থ ওয়াজ অথবা নসীহত হিসেব মুসল্লীদেরকে বলে দেওয়া যেতে পারে। এ ব্যাপারে আমাদের জমহুর তথা সংখ্যাগরিষ্ঠ উলামায়ে কেরাম একমত পোষণ করেছেন। এবং সেমতে বাংলাদেশে প্রায় সব মসজিদেই পারিভাষিক খুৎবার আগে খতিবগণ বাংলাভাষায় কিছুক্ষণ ওয়াজ ও নসীহত করে থাকেন। এই তরীকাটিই ইতিহাস ও হাদীসের সাথে অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ। আল্লাহ তা’আলা সবাইকে সঠিক তরীকায় আমল করার তাওফীক দান করেন। নতুনত্ব ও বিদ’আত সৃষ্টি করে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা শরীয়তের কাম্য নয়। বরং স্থান-কাল পাত্র হিসেবে প্রজ্ঞার সাথে শরীয়তের হুকুমের উপর আমল করাই কোরআন-সুন্নাহর দাবী। আল্লাহ তা’আলা আমাদের সবাইকে বিভ্রান্তি থেকে বাঁচার তাওফীক দান করুন। আমীন।
খুৎবা চলাকালীন সময় দুরূদপাঠ
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নাম মোবারক শ্রবণের সাথে সাথেই যেহেতু তাঁর জন্য দুরূদ পাঠ করা শ্রোতাদের উপর ওয়াজিব, তথাপি জুম’আর খুৎবার প্রতি গুরুত্বারোপস্বরূপ হুকুম হল খুৎবার সময় মুখে উচ্চারণ করে দুরূদ শরীফ না পড়া। যেমনিভাবে খুৎবার সময় নামাজ পড়া ও কথা বলা নিষেধ তেমনিভাবে উচ্চস্বরে দুরূদপাঠ করাও নিষেধ। শুধুমাত্র মনে মনে দুরূদ পাঠ করার অনুমতি রয়েছে। (ফাতাওয়া শামী: ৩/৩৫)
জুম’আর খুৎবা শেষ হবার পূর্বেই উপস্থিত মুসল্লীদের দাঁড়িয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে
জুম’আর দিন কিছু লোক খুৎবাপাঠ শেষ হবার পূর্বেই তাড়াহুড়ো করে দাঁড়িয়ে যায়, কাতার সোজা করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাহ্যিকভাবে উক্ত আমলটি সুন্দর দেখা গেলেও খুৎবার শেষ পর্যন্ত শ্রবণ করার ওয়াজিব হুকুমের পরিপন্থী হবার কারণে এমনটা করা নিষেধ। কেননা, এতে করে খুৎবাপাঠ ও তা শ্রবণে অন্যান্যদের মাঝে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। তাই খুৎবা শেষ হলেই শুধুমাত্র দাঁড়ানোর অনুমতি রয়েছে। (বাদায়েউস সানায়ে’: ১/৫৯৩)