কওমী মাদরাসা পরিচালনা ও আদর্শিক মতাদর্শ এর ব্যাপারে শাইখুল ইসলাম হযরত মাওলানা সায়্যিদ হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ. এর মূল্যবান পরামর্শ
কওমী মাদরাসা মৌলিকভাবে কুরআন-সুন্নাহর সঠিক শিক্ষা এবং সাহাবা, তাবেঈন, তাবে’ তাবেঈন, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন ও পূর্ববর্তী আকাবির ও আসলাফের চিন্তা-চেতনা এবং তাদের মতাদর্শে লালিত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কওমী মাদরাসার মিশন মূলত নতুন কোন মিশন নয়। বরং জনাব রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দ্বীন প্রচারের প্রাতিষ্ঠানিক কেন্দ্র “সুফ্ফা” এর একটি জীবন্ত প্রতীক বা আদর্শ নমুনা। তাই কুরআন-সুন্নাহ্র শিক্ষার পরিপন্থী কোন শিক্ষা এবং পূর্ববর্তীদের আদর্শ পরিপন্থী কোন বিষয় কওমী মাদরাসায় বাস্তবায়ন করার চিন্তা করাও অসম্ভব।
যখনই এ ধরণের কোন বাতিল মতাদর্শ এখানে মাথাচারা দিয়ে উঠতে চাবে, যা কুরআন-সুন্নাহবিরোধী তখন সেটা আদর্শিকভাবে কওমী মাদরাসার মানদন্ড থেকে বেরিয়ে যাবে। এজন্য শাইখুল ইসলাম হযরত মাওলানা সায়্যিদ হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ.কওমী মাদরাসা পরিচালনা ও আদর্শিক মতাদর্শ এর ব্যাপারে মূল্যবান পরামর্শ প্রদান করেছেন। যা সোনালী অক্ষরে লিখে সংরক্ষণ করে রাখার মত এবং পরিচালকবৃন্দদেরকে তা সামনে রেখে মাদরাসা পরিচালনা করা উচিৎ। সে পরামর্শের সারকথা নিম্মরূপ:
মুহতারাম ও সম্মানিত পরিচালকবৃন্দ! আমরা আমাদের পূর্ববর্তীদেরকে এ ব্যাপারে পূর্ণ সতর্কতা অবলম্বন করতে দেখেছি এবং বিশেষকরে হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত মাওলানা কাসেম নানুতবী রহ. (ঐতিহ্যবাহী দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা) এর ওসিয়্যত মোতাবেক মাদরাসার পরিচালকবৃন্দদেরকে চিন্তা-চেতনা ও আদর্শিকভাবে একমত পোষণকারী হওয়াও আবশ্যক। তা না হয়ে ভিন্নমতাবলম্বী হওয়া কখনই কাম্য নয় বরং তা আদর্শিকভাবে মাদরাসাসমূহের জন্য ক্ষতিকারক একটি দিক।
তাই আমাদের পূববর্তী আকাবিরদের আদর্শিক চিন্তা-চেতনা ও মতাদর্শ নিম্নে তুলে ধরা হলো-
তারা সকলেই ছিলেন মুকাল্লিদ বিশেষত হানাফী মাযহাবের অনুসারী
আক্বীদাগতভাবে ছিলেন ‘সুন্নী মা-তুরীদী ও আশআরী’
তরীকতের ক্ষেত্রে চিশতী, নকশবন্দী, কাদেরী ও সোহরাওয়ার্দী
সকল ধরণের বিদ’আত ও রুসূমাত থেকে পূর্ণবিমুখী।
এসব চিন্তা-চেতনা ও মতাদর্শ আমাদের পূর্ববর্তী সকল আকাবিরদেরই ছিল। এর বিপরীত মতাবলম্বীদের সবাইকে আমরা কাফেরও বলি না আবার সবাইকে ফাসেকও বলি না এবং বাড়াবাড়ি করে সবার সাথে শত্রুতামূলক আচরণও করি না। (তবে যদি কেউ কুফুরী আক্বীদা পোষণ করে অথবা ফিসকী কোন গুনাহ করে, তাহলে তার কর্ম হিসেবে তাকে সে হিসেবে গণ্য করবে)
আমাদের মোবারক এই কওমী মাদরাসায় ভিন্ন মতাদর্শীদের উপস্থিতিকে আমরা প্রতিষ্ঠানের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক ও লাভের তুলনায় নুকসান বলে মনে করি। এবং বাস্তবতাও ঠিক তদ্রুপ। কোন প্রতিষ্ঠান ভিন্ন মতাদর্শীদের লাভবান হতে পারে না। গাইরে মুকাল্লিদ এবং বেদআতীদের অংশগ্রহণের দ্বারা প্রতিষ্ঠানের আমল বিশেষতঃ শিক্ষা কারিক্যুলাম ক্ষতি ও ধ্বংসের মুখে পতিত হবে। যদিও তাদের মতাদর্শসমূহ কুফুরীর পর্যায়ের নয়, তথাপিও যখন এতোই ক্ষতিকারক প্রমাণিত হলো, তাহলে যাদের মতাদর্শ সম্পূর্ণ কুফুরীর পর্যায়ের তাদের দ্বারা কতবড় ক্ষতি হতে পারে তা স্বাভাবিকভাবে সহজেই অনুমেয়। অতএব কাদিয়ানী ও শিয়াদের থেকে আমাদেরকে আমাদের কওমী শিক্ষাঙ্গনকে সম্পূর্ণরূপে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
মওদূদী মতবাদ গাইরে মুকাল্লিদ মতবাদ এর তুলনায় কোনভাবেই কম ক্ষতিকারক নয়। মৌলানা মওদূদী সাহেব এর লিখা ও রচনা উল্টে দেখুন যে, তিনি শুধু ইমাম আবু হানীফা এবং অন্যান্য ইমামগণ ও ফুকাহায়ে কেরামদেরই শুধু বদনাম বা শুধু তাদেরকেই অপছন্দ করতেন না বরং তাদের থেকে হাজারো গুণ মর্যাদায় উন্নিত সাহাবায়ে কেরাম রা. ও খোলাফায়ে রাশেদীনদেরও বদনাম এবং অপছন্দ করতেন। (নাউযুবিল্লাহ!)
হাদীস বিশারদ, মুহাদ্দিসীন ও মুজতাহিদীন উলামায়ে কেরামের ব্যাপারেও মারাত্মক খারাপ মন্তব্য করেছেন। সুতরাং এ ধরণের বাতিল ও গোমরাহ মতাবলম্বী কোন শিক্ষক যদি কওমী মাদরাসায় থাকেন তাহলে সে মাদরাসার ছাত্রগণ কি-ই বা শিখতে পারে তা আমাদের সামনে পরিস্কার।
যে ব্যক্তি হযরত ইমাম আবুল হাসান আশআরী রহ., ইমাম গাযালী রহ., মুজাদ্দেদে আলফে ছানী রহ., হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ., হযরত শাহ আব্দুল আযীয রহ., হযরত খাজা মাইনুদ্দীন চিশতী রহ. প্রমুখ আকাবীরে উম্মতদের ব্যাপারে বেআদবীমূলক মন্তব্য করে বেড়ায় এবং যার লিখায় ইঙ্গিতবহ এ ধরণের অশালীন কথায় ভরপুর তাকে সমর্থনকারী শিক্ষক- ছাত্রদের মাঝে গোমরাহী ও ভ্রান্ত মতবাদ প্রচার করা ছাড়া আর কি করবে।
অতএব আমার অভিমত হলো, বাতিল ও গোমরাহ্ কোন দলের সমর্থনকারী কোন শিক্ষক, পরিচালক বা কোন ছাত্র কওমী মাদরাসার অংশ হতে পারবে না বা কওমী মাদরাসার হিতাকাঙ্খী হতে পারে না। আল্লাহ তা’আলা সকল ধরণের গোমরাহ এবং ভ্রান্ত মতবাদ থেকে ও ভ্রান্ত মতাদর্শাবলম্বী ব্যক্তিদের থেকে কওমী মাদরাসাকে হেফাজত করেন। আমীন। (মাকতুবাতে শাইখুল ইসলাম: ৩/৯৩, মাকতুব নং-১৪)