যানবাহন মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ও উত্তরন উপায়
বিবিসি সহ সকল প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রিক মিডিয়া্র মাধ্যমে আমরা জানতে পারলাম সম্প্রতি সময়ে যানবাহন দুর্ঘটনায় অনেক প্রাণ হারিয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, গেল ঈদের ছুটিতে ২১০টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ২৬৫ জন নিরীহ মানুষ। (২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬)
যারা এসব দুর্ঘটনায় বিদায় নিয়েছে তাদের জন্য আমরা দুয়া করি, আল্লাহ তাআলা যেন তাদের পরকালকে সুখের করে দেন এবং তাদের জীবনের কৃত অপরাধকে ক্ষমা করে দেন। আর তাদের বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তান ও শোকার্ত আত্মীয় স্বজনদের সবর ও ধৈর্যধারণ করার তাউফিক দান করেন এবং তাদের জীবন চলার জন্য বৈধ উপার্যন ও রিজিকের ব্যবস্থা সহজ করে দেন।
প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা! বিপদাপদ সুখ-দুঃখের মাঝেই মানুষের জীবন। এদুনিয়ার সুখও স্থায়ী নয় আবার দুঃখও চিরস্থায়ী নয়। সুখ দুঃখ কম বেশী সবার জীবনেই আছে বা আসবে। এটা বিধাতার বিধান। কথা হল বিপদ আসলে আমাদের করনীয় কী?
এব্যপারে আল্লাহ তাআলা বলেন,
{وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِنَ الْخَوْفِ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِنَ الْأَمْوَالِ وَالْأَنْفُسِ وَالثَّمَرَاتِ وَبَشِّرِ الصَّابِرِينَ} {الَّذِينَ إِذَا أَصَابَتْهُمْ مُصِيبَةٌ قَالُوا إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ} [البقرة:155,156]
অনুবাদঃ আর অবশ্যই আমি তোমাদিগকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের। যখন তারা বিপদে পতিত হয়, তখন বলে, “ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন” ( নিশ্চয় আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তাঁরই সান্নিধ্যে ফিরে যাবো)। (সূরা বাকারা, ১৫৫,১৫৬)
আয়াত থেকে আমাদের শিক্ষনীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, বিপদ আসলে “ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিঊন” পড়া এবং এই বিপদের কারণে আল্লাহ তাআলার উপর কোন অভিযোগ আপত্তি বা বিরোপ কোন মন্তব্য না করা ও এ ধরণের কোন মনভাব অন্তরে পোষন না করা।
এতটুকু কাজ যদি আমরা দিলে প্রাণে করতে পারি তাহলে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আমরা অনেক মূল্যবান পুরস্কার পাব। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
{أُولَئِكَ عَلَيْهِمْ صَلَوَاتٌ مِنْ رَبِّهِمْ وَرَحْمَةٌ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُهْتَدُونَ } [البقرة: 157]
অনুবাদঃ তারা সে সমস্ত লোক, যাদের প্রতি আল্লাহর অফুরন্ত অনুগ্রহ ও রহমত রয়েছে এবং এসব লোকই হেদায়েত প্রাপ্ত। (সূরা বাকারা,১৫৭)
এই আয়াত থেকে পরিষ্কার হল যে, বিপদাপদে ধৈর্য্যধারণের পুওস্কার হল, ১. আল্লাহ তাআলার অফুরন্ত অনুগ্রহ। ২. আল্লাহ তাআলার রহমত ও দয়া প্রাপ্ত হওয়া। ৩. আল্লাহর পক্ষ্য থেকে হেদায়েত প্রাপ্ত হওয়া।
বিপদাপদ ও দুর্ঘটনার ব্যপারে ইসলামী মূল্যায়নঃ
মানুষকে ইসলাম বিপদাপদের পথ এড়িয়ে চলার নির্দেশ দিয়েছে। আল্লাহ তাআলার উপর পরিপূর্ণ আস্থা বিশ্বাস এবং তার উপর তাওয়াক্কুল করেই রোগীর চিকিৎসা করা,বিপদের পথ থেকে দূরে থাকার বিধান ইসলাম ধর্মে রয়েছে। ইসলামের এ বিধান পালনের জন্য সবার জন্য আবশ্যক হল নিম্নের আমলগুলো করা। আশা করা যায় ইনশা আল্লাহ যানবাহনের মর্মান্তিক দুর্ঘটনা কমে আসবে।
সফর অবস্থায় আল্লাহ তাআলাকে স্মরণ করাঃ
আল্লাহর সাহায্য ছাড়া বান্দা্র জীবন চলা সম্ভব নয়। বাড়িতে থাকাবস্থায় যেমন আল্লাহ তাআলার সাহায্য জরুরী এমনিভাবে সফরেও আল্লাহ তাআলার সাহায্য জরুরী। তাই জনাব রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরে বের হওয়ার সময় আল্লাহ তাআলাকে স্মরণে দুয়া করে বের হতেন। একজন মুমিন হিসেবে আমাদের জন্য জরুরী হল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুসরণ করা। তিনি সফরে বের হবার সময় এবং সফরে যে সকল দুয়া পড়তেন তা হল,
১। হযরত ইবনে উমর রাযি. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সফরে বের হওয়ার উদ্দেশ্যে উটের পিঠে আসিন হতেন। তখন তিনবার আল্লাহু আকবার বলতেন। অতঃপর এই দোয়া পড়তেন,
«سُبْحَانَ الَّذِي سَخَّرَ لَنَا هَذَا وَمَا كُنَّا لَهُ مُقْرِنِينَ وَإِنَّا إِلَى رَبِّنَا لَمُنْقَلِبُونَ. اللَّهُمَّ إِنَّا نَسْأَلُكَ فِي سَفَرِنَا هَذَا الْبِرَّ وَالتَّقْوَى، وَمِنَ الْعَمَلِ مَا تَرْضَى، اللَّهُمَّ هَوِّنْ عَلَيْنَا سَفَرَنَا هَذَا وَاطْوِ عَنَّا بُعْدَهُ. اللَّهُمَّ أَنْتَ الصَّاحِبُ فِي السَّفَرِ، وَالْخَلِيفَةُ فِي الأَهْلِ. اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ وَعْثَاءِ السَّفَرِ وَكَآبَةِ الْمَنْظَرِ وَسُوءِ الْمُنْقَلَبِ فِي الْمَالِ وَالأَهْلِ وَالوَلَدِ»
ফেরার সময় এর সাথে আরো এতিটুকু বৃদ্ধি করতেন,
«آيِبُونَ تَائِبُونَ عَابِدُونَ لِرَبِّنَا حَامِدُونَ»
(মুসলিম শরীফ,১৩৪২)
২। হযরত আলী ইবনে রাবিআ রহ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আলী ইবনে আবী তালিব (কাররমাল্লাহু ওয়াজহাহু)-র সাক্ষাত পেলাম। তার কাছে একটি বাহন জন্তু আরহন করার জন্য আনা হল। তিনি তার রেকাবে পা রেখেই বিসমিল্লাহ বললেন। এরপর যখন এতে উপবেশন করলেন তখন বললেন,
الحَمْدُ للهِ الَّذِي سَخَّرَ لَنَا هَذَا وَمَا كُنَّا لَهُ مُقْرِنينَ، وَإنَّا إِلَى رَبِّنَا لَمُنْقَلِبُونَ
অতঃপর তিনবার আলহামদুলিল্লাহ ও তিনবার আল্লাহু আকবার বললেন। তারপর এই দুয়া পড়লেন,
سُبْحَانَكَ إنّي ظَلَمْتُ نَفْسِي فَاغْفِرْ لِي إنَّهُ لاَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلاَّ أنْتَ
এরপর তিনি হেসে উঠলেন।তখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, হে আমীরুল মু’মিনীন! কিসে আপনার হাসি পেল? তিন বললেন, আমি যা যা করলাম রাসূল সা. কেউ তেমনটা করতে দেখেছি। তিনিও এরপর হেসে উঠেছিলেন। তখন আমি জানতে চাইলাম, হে আল্লাহর রাসূল! কিসে আপনার হাসি পেল? তিন বলেছিলেন, তোমার প্রতিপালক তার বান্দার প্রতি বিস্ময়াবিভুত হন। যখন সে বলে, হে আমার প্রভু!আমার পাপরাশির জন্য আমাকে ক্ষমা করে দিন ও বিশ্বাস রাখে আমি ছাড়া অন্যকেউ তার পাপরাশি ক্ষমা করার কেউ নেই।(আবু দাউদ শরীফ ২৫৯৪)
উক্ত হাদীসের আলোকে আমরা এভাবে আমল করা যেতে পারে, (সকলের সুবিধার্থে উচ্চারণ সহ দেয়া হল, উচ্চারণ দেখে পড়লেও আরবী মূলপাঠের সাথে মিলিয়ে নিবে)
# যানবাহনে বিসমিল্লাহ বলে চড়বে। এরপর আরোহন করে তিনবার আল্লাহু আকবার বলে এই দুয়া পড়বে,
«سُبْحَانَ الَّذِي سَخَّرَ لَنَا هَذَا وَمَا كُنَّا لَهُ مُقْرِنِينَ وَإِنَّا إِلَى رَبِّنَا لَمُنْقَلِبُونَ. اللَّهُمَّ إِنَّا نَسْأَلُكَ فِي سَفَرِنَا هَذَا الْبِرَّ وَالتَّقْوَى، وَمِنَ الْعَمَلِ مَا تَرْضَى، اللَّهُمَّ هَوِّنْ عَلَيْنَا سَفَرَنَا هَذَا وَاطْوِ عَنَّا بُعْدَهُ. اللَّهُمَّ أَنْتَ الصَّاحِبُ فِي السَّفَرِ، وَالْخَلِيفَةُ فِي الأَهْلِ. اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ وَعْثَاءِ السَّفَرِ وَكَآبَةِ الْمَنْظَرِ وَسُوءِ الْمُنْقَلَبِ فِي الْمَالِ وَالأَهْلِ وَالوَلَدِ»
উচ্চারনঃ সুবহানাল্লাযী সাখ্খর লানা- হাযা ওয়ামা কুন্না- লাহু মুকরিনীন, ওয়াইন্না- ইলা রব্বিনা- লামুনকলিবূন। আল্লাহুম্মা ইন্না নাসআলুকা ফী সাফারিনা- হাযাল বিররা ওয়াত তাকওয়া, ওয়ামিনাল ‘আমালি মা-তারয-, আল্লাহুম্মা হাওউইন আলাইনা- সাফারনা-হাযা ওয়াতউয়ি আন্না বু’দাহ। আল্লাহুম্মা আ্নতাস সহিবু ফিস সাফারি, ওয়াল খলীফাতু ফিল আহলি। আল্লাহুম্মা ইন্নী আয়ু’যু বিকা মিন ওয়াছা-ইসসাফারি ওয়া কিতাবাতিল মানযরি ওয়াসূইলমুনকলাবি ফিলমা-লি ওয়াল আহলি ওয়াল ওয়ালাদি।
ফেরার সময় এর সাথে আরো এতিটুকু বৃদ্ধি করবে,
«آيِبُونَ تَائِبُونَ عَابِدُونَ لِرَبِّنَا حَامِدُونَ»
আ-ইবূনা তা-ইবূনা ‘আ-বিদূনা লিরব্বিনা-‘হা-মিদূন
# এরপর তিনবার আলহামদুলিল্লাহ ও তিনবার আল্লাহু আকবার বলবে। তারপর এই দুয়া পড়বে,
سُبْحَانَكَ إنّي ظَلَمْتُ نَفْسِي فَاغْفِرْ لِي إنَّهُ لاَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلاَّ أنْتَ
সুবহানাকা ইন্নী যলামতু নাফসী, ফাগফিরিলী ইন্নাহু লাইয়াগফিরুয যুনূবা ইল্লা আংতা
# এছাড়াও বুজুর্গানেদ্বীন উক্ত মাসনূন দুয়ার সাথে সাথে এদু’টি আয়াতও পড়তেন,
[فَاللَّهُ خَيْرٌ حَافِظًا وَهُوَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ} [يوسف: 64}
ফাল্লাহু খইরুন হাফিযাও ওয়াআরহামুর রহহিমীন।
[وَمَا قَدَرُوا اللَّهَ حَقَّ قَدْرِهِ وَالْأَرْضُ جَمِيعًا قَبْضَتُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَالسَّمَاوَاتُ مَطْوِيَّاتٌ بِيَمِينِهِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ } [الزمر: 67}
ওয়ামা-কদারুল্লাহা হাক্ক্বা ক্বদরিহী ওয়াল আরযু জামী’আ ক্ববাযতুহূ ইয়াওমাল ক্বিয়ামাতি ওয়াসসামাওয়াতু মাতউইয়্যাতুন বিয়ামীনিহী সুবহানাহূ ওয়াতাআলা ‘আম্মা- ইউশরিকূন।
যাত্রাপথে চালক সজাগ ও সতর্ক থাকা
গাড়ি, বাস, ট্রেন, লঞ্চ থেকে নিয়ে সব ধরণের যানবাহনের চালককে সবদিকে খেয়াল করে অনেক সতর্কতা ও ধর্য সহকারে দায়িত্ব নিয়ে যানবাহন চালাতে হবে। সাধারণত অমনযোগী হওয়া ও ঝুকি পূর্ণ ভাবে অভারটেকের কারণে সড়ক দুর্ঘটনা হয়ে থাকে। তাই চলন্ত অবস্থায় যে সকল কাজে মনযোগে বিগ্ন সৃষ্টি করে যেমন গান শোনা, মোবাইলে কথা বলা, কানে ইয়ার ফোন লাগিয়ে রাখা, টিভি দেখা ইত্যাদি। এসকল কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। এবং ঝুকিপূর্ণ ওভারটেকের অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে সম্পূর্ণ বেচে থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে চালকের হাতে সকলের নিরাপদে বাড়ি ফিরা নির্ভরশীল। তাই চালকের যে কোন দায়িত্বহীনতার জন্য যে কারো জীবন অনিশ্চয়তার মাঝে পরে যেতে পারে।ঘটতে পারে প্রাণহানীর মত মারাত্মক দুর্ঘটনা। আল্লাহ আমাদের সকলক্ব হেফাজত করুন। আমীন।
অদক্ষ চালক এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ির ব্যপারে সতর্ক থাকা
সরে জমিনে দেখা যায় সড়ক দুর্ঘটনার জন্য অদক্ষ চালক ও ফিটনেস বিহীন গাড়ি অনেকাংশে দায়ী। ঈদ ও দীর্ঘ ছুটি উপলক্ষে দেশের অনেক মানূষ কর্মস্থল থেকে বাড়ি ও বাড়ি থেকে কর্মস্থলে যাতায়াত করে। সে সময় গনপরিবহনের চাহিদা থাকে ব্যপক। মানুষের এই চাহিদাকে পুঁজি করে অসাধু কিছু ব্যবসায়ী ওয়ার্কশপে পড়ে থাকা ভাঙ্গাচোড়া গাড়ি জোড়াতালি দিয়া কোন রকম চলাচল যোগ্য করেই রাস্তায় নামিয়ে দেয় এবং অদক্ষ চালকের মাধ্যমে গাড়ি পরিচালনা করে। এতে করে বছরের এই সময়গুলোতে সড়ক দুর্ঘটনার হার অনেকাংশে বেড়ে যায়। তাই সরকার ও সংস্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এব্যপারে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। প্রয়োজনে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সকলের সতর্কতা ও প্রয়োজনিয় পদক্ষেপ আমাদের বাচিয়ে দিতে পারে প্রতি বছরের সড়ক দুর্ঘটনার এই অভিশাপ থেকে।
জাজাকাল্লাহ,, অনেক মুল্যবান আমল। আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে সকল বিপদ আপদ থেকে হেফাজত করুন। এবং এই আমল করার তাউফিক দান করুন। আমিন