দুই উস্তাদের কবরের পাশে কিছুক্ষণ
১লা মার্চ ২০১৭ খৃষ্টাব্দ। বিকাল ৪টা। মাওলানা ইউসুফের দাওয়াতে চাঁদপুরস্থ হাজীগঞ্জের এক মাহফিলে শরীক হওয়ার উদ্দেশ্যে চাঁদপুর লঞ্চ টার্মিনালে অবতরণ করলাম। আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য সেখানে সি.এন.জি নিয়ে উপস্থিত ছিলেন ফুলছোঁয়া মাদরাসার মুহাদ্দিস মাওলানা নু’মান আহমাদ। গাড়িতে উঠে মাওলানার কাছে জানতে পারলাম, মাহফিলটি হাজীগঞ্জের সন্নিকটেই। এতটুকু শুনতেই ছোটবেলার সব রূহানী স্মৃতি মনে পড়ে যায়। স্মৃতি বিজড়িত স্থানটি হল, উয়ারুক, হাটিলা খাসের বাড়ী, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর। সেখানেই অবস্থিত ঐতিহাসিক ‘মহিউসসুন্নাহ মাদরাসা’। যার খুব কাছেই নির্মিত একটি কবরস্থান; যেখানে শায়িত আমার পরম শ্রদ্ধেয় দু’জন উস্তাদ-
১. হযরত মাওলানা ইমরান হুসাইন রহ. (মৃত্যু: ২২ সেপ্টেম্বর, ২০০৯ ইং)
২. হযরত মাওলানা আবুল কাসেম রহ. (মৃত্যু: ১৩ আগষ্ট, ২০১৫ ইং)
এক পর্যায়ে আমার অবস্থান থেকে মেজবানের পরামর্শক্রমে অনুমতি নিয়ে রওয়ানা হলাম হাটিলার উদ্দেশ্যে উস্তাদের কবর যিয়ারত করার জন্য। কবরের পাশে দাঁড়িয়ে মাসনুন দু’আ ও হযরতদের মর্যাদার বুলন্দী কামনায় আল্লাহর কাছে দরখাস্ত করলাম। মনের আবেগ, উস্তাদদের স্মৃতি-মমতা সবই চোখের সামনে ভেসে উঠলো। স্মৃতিপটে উঁকি মারল আজ থেকে প্রায় ৩২ বছর পূর্বের কথা। তখন আমি দ্বীনি ইলম হাসিল করার লক্ষ্যে ভর্তি হই ‘মুন্সীগঞ্জের দিঘীরপাড় মুহাম্মাদিয়া মাদরাসায়।’
আমার মাদরাসা জীবন (কিতাব বিভাগ) এর শুরু এখানে থেকেই। যেদিন মাদরাসায় পা রেখেছিলাম, সেদিন থেকে পিতৃস্নেহ দিয়ে যেই মহান ব্যক্তিত্ব হাঁটি হাঁটি পা- পা করে অবুঝ এই ছোট্ট বালককে এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়েছিলেন, তিনি হলেন হযরত মাওলানা ইমরান হুসাইন রহ.। উর্দূ জামাত থেকে শুরু করে নাহবেমীর জামাত পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিতাবগুলো সযত্নেই পড়িয়েছিলেন তিনি। পাশাপাশি হাতের লেখা, আকাবিরদের স্মৃতিচারণ ও ভবিষ্যতে উজ্জল জীবন গড়ার অনেক কাহিনীই শুনেছি তাঁর যবান মুবারক থেকে।
অত্যন্ত আবেগ ও উদ্দীপনার সাথে শুরু হয় নাহবেমীর জামাতের শিক্ষাবর্ষ। নাহবেমীরের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘বদরে মুনীর’ উস্তাদে মুহাতরামই নিজ টাকা দিয়ে কিনে দিয়েছিলেন আমাকে।
আজ পরিতাপের সাথে পূর্বের ইতিহাস বলতে হচ্ছে, ‘হঠাৎ মাদরাসা কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিল, এখন থেকে মাদরাসা আলিয়ার সিলেবাসে চলবে। কুরবানীর পর থেকে আলিয়ার দৌড় শুরু হবে।’ সেদিন জানা ছিল না, আলিয়া ও কওমী মাদরাসার ব্যবধান। মাওলানা ইমরান সাহেব অন্ধকারের পর্দা উঠিয়ে দু’শিক্ষার ভবিষ্যত কী হতে পারে সবই বুঝানোর চেষ্টা করেছিলেন এবং এটাও জানতে পারলাম যে, উস্তাদে মুহতারাম কুরবানীর পর আর আসছেন না আলিয়া সিলেবাসের এই দিঘীরপাড় মাদরাসায়। বরং তাঁর নিজ বাড়ীর সন্নিকটে ‘মুহিউস সুন্নাহ’ মাদরাসায় ইলমে ওহীর র্দস প্রদান করবেন। ইতিপূর্বে যেহেতু আকাবিরে দেওবন্দের কুরবানীর অনেক কাহিনী তিনি আমাদের শুনিয়েছিলেন, তাই আমি সেদিন খুব ছোট হওয়া সত্ত্বেও উস্তাদভক্তি ও ইলমের পিপাসায় আশ্রয় নেই সুদূর সেই চাঁদপুর, হাজীগঞ্জের উয়ারুক এর হাটিলা খাসের বাড়ীর টিনের মসজিদ ও ভাঙ্গা একটি টিনের ঘরের ছায়াতলে। যদিও কখনো নিজ বাড়ী ছেড়ে থানা শহরেও যাই নি। কিন্তু সেখানে ইট ও রেহালে কিতাব রেখে পড়ার আগ্রহ আমার হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিল শুধুমাত্র আকাবিরদের সেই সোনালী ইতিহাস পড়ার কারণে, জানার কারণে। তাই আজও তাঁদের আদর্শ আমার পথ চলার উত্তম পাথেয়। তখন ঐ মাদরাসায় বোর্ডিং ও ছাত্রাবাসের তেমন কোন ব্যবস্থাপনা ছিল না। তাই আমাদের মত কয়েকজন পাগল ও অধম ছাত্রদের খাওয়া-দাওয়ার জন্য পরম শ্রদ্ধেয় দু’উস্তাদ পরামর্শ করে ঐ গ্রামের কয়েকজনের বাড়ীতে লোজিং এর ব্যবস্থা করে দেন। সেই সুবাদে আমার লোজিং এর ব্যবস্থা হয় উস্তাদে মুহতারাম হযরত মাওলানা ইমরান সাহেবের বাড়ীতে। এমন একজন মুশফিক উস্তাদ খুঁজে পাওয়া সত্যিই অনেক মুশকিল ও দুস্কর।
কোন দুশ্চিন্তা, কোন পেরেশানী ছাড়াই পিতৃস্নেহের পরশে একদিন দু’দিন কাটছিল। এভাবে চলে যায় পর্যায়ক্রমে বিশদিন। এ বিশদিনের মাথায় মায়ের ডাকে বাধ্য হয়ে বাড়ীতে চলে আসতে হয়। মাতৃমমতায় মা ভেঙ্গে পড়েন। কোনমতেই সুদূর সেই চাঁদপুরে যেতে অনুমতি দিতে রাজি হচ্ছিলেন না। তাই আল্লাহর ফায়সালায় নাহবেমীর জামাতের বাকী দিনগুলো কাটাতে হয় নারায়ণগঞ্জের দেওভোগ মাদরাসায়।
যাই হোক, সেদিন (১লা মার্চ-২০১৭) চাঁদপুর থেকে সি.এন.জি যোগে হাজীগঞ্জের দিকে যেতে যেতে এসব ইতিহাস স্মৃতিপটে উদয় হয়। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম আমাকে অবশ্যই সেখানে যেতে হবে। উস্তাদের কবর যিয়ারত না করে ফিরে এলে নাশুকরিয়া হবে-অকৃতজ্ঞতা হবে। কিন্তু বত্রিশ বছর এর পূর্বের কথা। মনে নেই কোন পথে সেখানে যেতে হবে। তাই ফোন করলাম ঢাকা চৌধুরীপাড়া মাদরাসার উস্তাদ মাওলানা মুসলিমুদ্দীন এর কাছে। সে মাওলানা ইমরান হুসাইন রহ. এর ছেলে মাওলানা সালমান থেকে রাস্তা-ঘাটের ঠিকানা নিয়ে আমাকে রাহনুমায়ী করলো। (জাযাহুমুল্লাহু তা’আলা)। কিছুক্ষণ পর মাওলানা সালমানের কল আসলো। আফসোস করে সে আমাকে বলতে লাগলো, ‘হাফীজ ভাই, বাড়ীতে কেউ নেই। আমাদেরকে না জানিয়ে চাঁদপুর সফর করছেন, অথচ আমরা আপনা সমাদর করতে পারলাম না।’ আমি বললাম, ‘ সমাদর এর কোন বিষয় নয়, উস্তাদের হক আদায় করতে আমি যেতে বাধ্য।’
পাঠক ও ছাত্রভাইদের কাছে অনুরোধ, উস্তাদদের হক যথাসাধ্য আদায় করার আপ্রাণ চেষ্টা করবে এবং কোন উস্তাদ এর অবদান ভুলে যেও না। হও তুমি যতই বড়; উস্তাদের কাছে-পিতার কাছে তুমি সেই ছোট্টই রয়ে গেছ। একথা সবসময় মনে রাখবে, তাহলে আল্লাহ পাক তোমাকে অনেক বড় বানাবেন ইনশাআল্লাহ।