কবর যিয়ারত সম্পর্কে শরীয়তে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি
১. কবর যিয়ারতে যাওয়া
জাহেলী যুগের কবর পূজা সম্পর্কে ঘৃণা সৃষ্টির জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের শুরু যুগে উম্মতকে কবরের কাছে যেতে নিষেধ করেছিলেন। এরপর যখন ঐ সময়ের রসম-রেওয়াজ ভালোভাবে দূর হল তখন তিনি কবর-যিয়ারতের অনুমতি দিয়ে বলেছেন-
كنت نهيتكم عن زيارة القبور، فزوروها، فإنها تزهد في الدنيا وتذكر الآخرة.
আমি ইতিপূর্বে তোমাদের কবর-যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। (এখন ঐ নিষেধ মানসূখ করা হচ্ছে) এখন তোমরা কবর যিয়ারত করতে পার। কারণ তা দুনিয়ার মোহ দূর করে এবং আখিরাতকে মনে করিয়ে দেয়।
(সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-নং-১৫৭১; মিশকাত: ১৫৪)
সুতরাং কবরস্থানে যাওয়ার অনুমতি আছে। তবে দুটি বিষয়ে কিছু মতভেদ রয়েছে-
এক. এ অনুমতি নারী-পুরুষ সবার জন্য, না শুধু পুরুষের জন্য। কিছু মনীষীর মতে নারীদের অনুমতি নেই। কারণ এক হাদীসে আবু হুরায়রা রা. বলেন-
أن رسول الله صلى الله عليه وسلم لعن زوارات القبور
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর যিয়ারতকারী নারীদের উপর অভিসম্পাত করেছেন। (মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-নং-৮৪৪৯; জামে তিরমিযী, হাদীস নং-নং-১০৫৬; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-নং-১৫৭৫; মিশকাত: ১৫৪)
আর কেউ কেউ বলেন, এটি অনুমতির আগের। এখন পুরুষের মতো নারীদেরও কবর যিয়ারতের অনুমতি আছে।
নারীদের নিষেধ করার তাৎপর্য এই যে, ইলম ও সবরের স্বল্পতার কারণে তারা ওখানে গিয়ে অস্থিরতা, কান্নাকাটি এবং বিদআত ও গায়রে শরয়ী আচরণ থেকে বিরত থাকতে পারে না। যেহেতু তাদের ওখানে যাওয়ায় ফিতনার আশঙ্কাই প্রবল, তাই তাদেরকে বিশেষভাবে নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং যদি কোনো নারী ওখানে গিয়ে কোনো প্রকারের বিদআত ও গায়রে শরয়ী কার্যকলাপে লিপ্ত না হন তাহলে তার অনুমতি আছে। তবে বৃদ্ধা নারীরা যেতে পারেন, যুবতীদের না যাওয়াই ভালো। (ফাতাওয়ায়ে শামী: ২/২৪২)
দুই. শুধু নিজ শহরের কবরস্থানে যাওয়া যাবে, নাকি অন্যান্য শহরেও নেককার অলী-বুযুর্গের কবর যিয়ারতে যাওয়ার অনুমতি আছে? কিছু মনীষীর সিদ্ধান্ত, কেউ যদি অন্য কোনো শহরে গিয়ে থাকে, তাহলে ওখানের কবরও যিয়ারত করতে পারে। কিন্তু শুধু কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে যাওয়া সহীহ না।
তবে ইমাম গাযালী রহ.সহ আরো অনেক মনীষীর মতে এরও অনুমতি আছে। আর এটাই সহীহ। তবে এই শর্তে যে, ওখানে গিয়ে শরীয়ত পরিপন্থী কোনো কাজে লিপ্ত হতে পারবে না।
২. কবর-যিয়ারতের মাসনুন তরিকা
কবর যিয়ারতের নিয়ম হল, মাইয়েতের চেহারার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে সালাম দিবে। অতপর দরূদ শরীফ ও কুরআন মাজীদ থেকে তিলাওয়াত করতে চাইলে করতে পারবে। অবশ্য উক্ত নিয়মে দাঁড়ানো সম্ভব না হলে যেভাবে সম্ভব সেভাবে দাঁড়াতে পারবে। যিয়ারত শেষে চাইলে কেবলামুখী হয়ে কবরবাসীর জন্য মাগফিরাতের দুআ করতে পারবে। (জামে তিরমিযী, হাদীস নং-১০৫৩; আলআওসাত, ইবনুল মুনযির: ৫/৫০৭; রদ্দুল মুহতার: ২/২৪২; মাজমাউল আনহূর: ৪/২২০; মিরকাতুল মাফাতীহ: ৪/২১৯)
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর যিয়ারতের এই তরীকা বলেছেন যে, কেউ যখন কবরস্থানে যায়, তখন কবরবাসীদের যেন এ বলে সালাম দেয়-
السلام عليكم دار قوم مؤمنين، أنتم لنا فرط ونحن لكم تبع، وإنا إن شاء الله بكم لاحقون، نسأل الله لنا ولكم العافية.
অর্থ: হে মুমিনদের বসতি! তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। তোমরা আমাদের পূর্বসূরী আর আমরা তোমাদের উত্তরসূরী। আর ইনশাআল্লাহ আমরা তোমাদের সাথে যুক্ত হব। আমরা আল্লাহর কাছে আফিয়াত চাই। আমাদেরও জন্য এবং তোমাদেরও জন্য। (মুসলিম শরীফ: ১/৩১৩,৩১৪; সুনানে নাসায়ী: ১/২২২)
এরপর কবরবাসীর জন্য মাগফিরাতের দু‘আ করবে এবং কিছু পড়ে ঈসালে ছওয়াব করবে। হাদীসে কিছু সূরা তেলাওয়াতের বিশেষ ফযীলতও উল্লেখিত হয়েছে। যেমন আয়াতুল কুরসী, সূরা ইয়াসিন ও সূরা ফাতেহা একবার, সূরা ইখলাস তিনবার তেলাওয়াত করবে। তেমনি দরূদ শরীফও ১১ বার পড়ার কথা এসেছে। আর দু‘আ হয়তো হাত না উঠিয়ে করবে অথবা কবরের দিকে পিঠ দিয়ে কিবলামুখী হয়ে করবে।
(রদ্দুল মুহতার: ২/২৪২, ইমদাদুল ফাতাওয়া: ১/৫০০, ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী: ৫/৩৫০, কিতাবুল কারাহিয়্যা)
৩. কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্য
এক. কবর-যিয়ারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য, যা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন। তা হলো, কবরের দৃশ্য দেখে দুনিয়ার ক্ষণস্থায়িত্বের বিশ্বাস অন্তরে স্থাপন করা, নিজের মৃত্যু ও কবর-জীবনকে স্মরণ করা এবং আখিরাতের প্রস্তুতির সংকল্প গ্রহণ করা।
দুই. আত্মীয়-স্বজনের হক আদায় করা এবং মাগফিরাতের দু‘আ ও ঈসালে ছওযাবের মাধ্যমে তাদের উপকৃত করা। আর আল্লাহওয়ালাদের কবর যিয়ারতের দ্বারা- যে পথে চলে তারা আল্লাহর দরবারে মাকবূল হয়েছেন ঐ পথে চলার দৃঢ় সংকল্প করা।
৪. কবর বিষয়ে প্রান্তিকতা
কবরের বিষয়ে শরীয়ত ইফরাত-তাফরীত (কোনো প্রকারের বাড়াবাড়ি-ছাড়াছাড়ি) অনুমোদন করে না। সুতরাং কবরের অসম্মানও যেমন নিষেধ তেমনি সম্মানে সীমা অতিক্রম করাও নিষেধ। হযরত জাবির রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর পাকা করতে, এর উপর গম্বুজ নির্মাণ করতে আর কবরের উপর বসতে নিষেধ করেছেন। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-নং-৯৭০; মিশকাতুল মাসাবীহ: ১৪৮)
এক হাদীসে আছে, ‘কবরের উপর বসবে না, কবরের দিকে ফিরে নামাযও পড়বে না।’(সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৯৭২)
আরেক হাদীসে আছে, ‘তোমাদের কেউ যেন কবরের উপর না বসে, সে জ্বলন্ত কয়লার উপর বসুক, যার কারণে তার পরিধেয় কাপড় পুড়ে তার শরীরও পুড়ে যায়- এ-ও তার জন্য ভালো।’ (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৯৭১)
এক হাদীসে আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কবর পাকা করতে, তার উপর কিছু লিখতে এবং তা পদদলিত করতে নিষেধ করেছেন।
(জামে তিরমিযী, হাদীস নং-১০৫২)
অন্য হাদীসে আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবী আমর ইবনে হায্ম রা.-কে কবরে হেলান দিয়ে বসে থাকতে দেখে বলেছেন, ‘কবরের অধিবাসীকে কষ্ট দিও না।’ (মুসনাদে আহমাদ, মিশকাতুল মাসাবীহ: ১৪৯)
এ সকল হাদীস থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, কবরের অসম্মানও কাম্য নয়, সীমাতিরিক্ত সম্মানও কাম্য নয়। তবে কবর তৈরী ও কবর যিয়ারতের ক্ষেত্রে শরীয়ত বিবর্জিত কোন কর্মকা- হলে তা সংশোধন করা জরুরি।
হযরত আলী রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে এ কাজে পাঠিয়েছিলেন যে, যে ছবি বা মূর্তিই দেখি, তা যেন বিলুপ্ত করি আর যে কবরই উঁচু দেখি তা যেন সমান করি।(সহীহ মুসলিম, মিশকাত শরীফ: ১৪৮)
এই হাদীসগুলো থেকে প্রমাণিত হয়, পাকা কবর বানানো বা কবরের উপর গম্বুজ নির্মাণ জায়েয নয়। স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর দুই সাহাবী (হযরত আবু বকর ও ওমর রা.)-এর কবরও পাকা নয়, কাঁচা।(সুনানে আবু দাউদ, মিশকাতুল মাসাবীহ: ১৪৯)
অতএব, ঐসব কার্যকলাপ সম্পর্কে চিন্তা করুন, যা আমাদের অজ্ঞ আওয়াম ও ওলী-বুযুর্গদের কবরে করা হয়ে থাকে। যেমন কবরে গিলাফ বসানো, বাতি জ্বালানো, কবরে সিজদা করা, তাওয়াফ করা, কবরে চুমু খাওয়া, কপাল ঘষা, কবরের সামনে হাত বেধে এমনভাবে দাঁড়ানো যেভাবে নামাযী আল্লাহর সামনে হাত বেধে দাঁড়ায়। কবরের সামনে রুকুর মতো ঝোঁকা, কবরের উদ্দেশ্যে মান্নত মানা ইত্যাদি। আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআত ও ফিকহে হানাফীর কিতাবাদিতে এই সকল বিষয়কে না-জায়েয লেখা হয়েছে।