কুরআন ও হাদীসের আলোকে আশারায়ে যিলহজ্জ-গুরুত্ব, ফযীলত ও বিশেষ আমল
আল্লাহ তা’আলার বিধানানুসারে যে চারটি মাস পবিত্র ও সম্মানিত, তার একটি হল যিলহজ্জ মাস। আর এমাসের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ও মর্যাদাপূর্ণ সময় হল আশারায়ে যিলহজ্জ বা যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিন। দুটি ইবাদত এ দশকের মর্যাদাকে আরো অধিক বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছে। কুরআন-হাদীসে এই দশকের বিশেষ ফযীলত ও অসীম গুরুত্ব ও তাৎপর্যের কথা বর্ণিত হয়েছে। স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা এই দশকের সম্মান ও পবিত্রতা প্রকাশান্তে এই দশকের রজনীগুলোর নামে শপথ করেছেন।
ইরশাদ হয়েছে,
والفجر، وليال عشر
শপথ ভোরবেলার, শপথ দশ রাত্রির। (সূরা ফজর: ১-২)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা., হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর রা. ও মুজাহিদ রহ. সহ অধিকাংশসাহাবী, তাবেয়ী ও মুফাসসিরের মতে এখানে দশ রাত্রির দ্বারা যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ রাতকেই বুঝানো হয়েছে। হাফেয ইবনে কাসীর রহ. বলেন, এটিই বিশুদ্ধ মত।
(তাফসীরে ইবনে কাসীর: ৪/৫৩৫-৫৩৬)
উত্তম ও মর্যাদাবান দশদিন
হাদীস শরীফে এই দশককে দুনিয়ার সবচেয়ে উত্তমও মর্যাদাবান দশক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। হযরত জাবের রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
أفضل أيام الدنيا العشر، يعني عشر ذي الحجة، قيل ولا مثلهن في سبيل الله؟ قال-ولا مثلهن في سبيل الله، إلا رجل عُفِّر وجهه بالتراب.
দুনিয়ার সর্বোত্তম দিনগুলো হল যিলহজ্জের দশ দিন। জিজ্ঞাসা করা হল, আল্লাহর রাস্তাও কি তার সমতুল্য নয়? তিনি বললেন, আল্লাহর রাস্তাও তার সমতুল্য নয়, তবে ঐ ব্যক্তি, যার চেহারা ধূলিযুক্ত হয়েছে, অর্থাৎ, শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করেছে। (মুসনাদে বাযযার, হাদীস নং-১১২৮; মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস নং-২০১০)
অন্য বর্ণনায় হযরত জাবের রা. হতে বর্ণিত হয়েছে
ما من أيام أفضل عند الله من أيام عشر ذي الحجة.
যিলহজ্জের দশ দিনের চেয়ে কোনো দিনই আল্লাহর নিকট উত্তম নয়।
(সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস নং-২৮৪২)
এই দশকের দিন-রাতসমূহে নেক আমলের গুরুত্ব হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে। হযরত ইবনে আববাস রা.বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
ما من أيام العمَلُ الصالح فيها أحب إلى الله عز وجل من هذه الأيام يعني أيام العشر، قالوا-يا رسول الله، ولا الجهاد في سبيل الله؟ قال-ولا الجهاد في سبيل الله، إلا رجل خرج بنفسه وماله، ثم لم يرجع من ذلك بشيء
আল্লাহর নিকট যিলহজ্জের দশ দিনের নেক আমলের চেয়ে অধিক প্রিয় অন্য কোনো দিনের আমল নেই। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও (এর চেয়ে উত্তম) নয়? তিনি বললেন, না, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও নয়। তবে হ্যাঁ, সেই ব্যক্তির জিহাদ এর চেয়ে উত্তম, যে নিজের জান-মাল নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের জন্য বের হয়েছে, তারপর কোনো কিছুই নিয়ে ফিরে আসেনি। (সুনানে আবুদাউদ, হাদীস নং-২৪৩৮; সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৯৬৯; সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং-৭৫৭; সুনানে ইবনে মাজাহ,হাদীস নং-১৭২৭; মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং-১৯৬৮; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস নং-৩২৪)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
عن ابن عمر، عن النبي صلى الله عليه وسلم قال: ” ما من أيام أعظم عند الله ولا أحب إليه العمل فيهن من هذه الأيام العشر، فأكثروا فيهن من التهليل والتكبير والتحميد “
অর্থাৎ, আল্লাহ তা’আলার নিকট আশারায়ে যিলহজ্জের আমলের চেয়ে অধিক মহৎ এবং অধিক প্রিয় অন্য কোন দিনের আমল নেই। সুতরাং তোমরা সেই দিবসগুলোতে অধিক পরিমাণে তাসবীহ (সুবহানাল্লাহ) তাহমিদ (আলহামদুলিল্লাহ) তাহলীল (লা ইল্লাহা ইল্লাল্লাহ) ও তাকবীর (আল্লাহু আকবার) পাঠ কর। (মুসনাদে আহমাদ,হাদীস নং-৬১৫৪; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং-১৪১১০; বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান, হাদীস নং-৩৭৫০; ত্ববারানী, হাদীস নং-১১১১৬; মাজমাউয যাওয়াইদ, হাদীস নং-৫৯৩২; শরহু মুশকিলিল আছার, হাদীস নং-২৯৭১)
কুরআনের উপরোক্ত আয়াত ও হাদীসসমূহের আলোকে স্পষ্ট বুঝা যায়, এই দশ দিনের যে কোনো নেক আমল আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়। তাই মুমিন বান্দার জন্য অধিক পরিমাণে সওয়াব অর্জন, আল্লাহর নৈকট্যলাভ এবং আখেরাতের পাথেয় সংগ্রহের এর চেয়ে উপযুক্ত সময় আর কী হতে পারে?
এজন্য পূর্ববর্তীদের জীবনীতে এই দশকের আমল সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে, যখন এই দশকের দিনগুলোর আগমন ঘটত তখন তাঁরা এতঅধিক আমল ও মুজাহাদা করতেন, যা পরিমাপ করাও সম্ভব নয়। আমাদেরও উচিত বিভিন্ন নেক আমলের মাধ্যমে এই দশকের রাত-দিনগুলোকে জীবন্ত ও প্রাণবন্ত করে তোলা।
অতএব এই দশক যেহেতু নেক আমলের বিশেষ সময় তাই এই দশ দিনের যে কোনো আমলই আল্লাহর নিকটপ্রিয় ও পছন্দনীয়, তাই অধিক পরিমাণে নফল নামায আদায় করা, রোযা রাখা, যিকির-আযকার, কুরআন তিলাওয়াত, তাসবীহ-তাহলীল ইত্যাদিও আল্লাহর নিকট পছন্দনীয়। তাই আল্লাহর নেয়ামত ও বিশেষ অনুগ্রহ মনে করে এই দশকে সাধ্যমতো নেক আমলের পাবন্দী করা একান্ত প্রয়োজন। তাছাড়া বিভিন্ন হাদীসে এই দশকের বিশেষ কিছু আমলের কথাও বর্ণিত হয়েছে।