জিলহজ্বের প্রথম দশ দিন যে আমলগুলো বেশি বেশি করা উচিত
১. হজ্জ ও উমরা সম্পাদন করা
এ দুটি হলো এ দশকের সর্বশ্রেষ্ঠ আমল। যারা এ দিনগুলোতে হজ্জ আদায়ের সুযোগ পেয়েছেন তারা যে অনেক ভাগ্যবান তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আল্লাহ যাকে তাঁর নির্দেশিত এবং রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদর্শিত পন্থায় হজ্জ বা উমরা করার তাওফীক দান করেন তার পুরস্কার শুধুই জান্নাত। কারণ, আবূ হুরায়রা রা. কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, .‘এক উমরা থেকে আরেক উমরা এতদুভয়ের মাঝের গুনাহগুলোর কাফফারা এবং মাবরূর হজ্জের প্রতিদান কেবলই জান্নাত।’ (বুখারী-১৭৭৩; মুসলিম-৩৩৫৫)
আর মাবরূর হজ্জ সেটি যা পরিপূর্ণভাবে সম্পাদিত হয় রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদর্শিত পন্থায়। যাতে কোনো রিয়া বা লোক দেখানো কিংবা সুমআ বা মানুষের প্রশংসা কুড়ানোর মানসিকতা নেই। নেই কোনো অশ্লীলতা বা পাপাচারের স্পর্শ। যাকে বেষ্টন করে থাকে নেক কাজ ও পুণ্যময় আমল।
২. চুল, নখ, মোচ ইত্যাদি না কাটা
যিলহজ্জের চাঁদ দেখার পর থেকে কুরবানীর আগ পর্যন্ত নিজের নখ, চুল, মোচ, নাভীর নিচের পশম ইত্যাদি না কাটা। এটা মুস্তাহাব আমল।
হযরত উম্মে সালামা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
إذا رأيتم هلال ذي الحجة وأراد أحدكم أن يضحي فليمسك عن شعره وأظفاره.
তোমরা যদি যিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখতে পাও আর তোমাদের কেউ কুরবানী করার ইচ্ছা করে তবে সে যেন স্বীয় চুল ও নখ কাটা থেকে বিরত থাকে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৯৭৭; তিরমিযী, হাদীস নং-১৫২৩, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-২৭৯১, সুনানে নাসায়ী, হাদীস নং-৪৩৬২, সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস নং-৫৮৯৭)
যে ব্যক্তি কুরবানী করতে সক্ষম নয় সেও এ আমল পালন করবে। অর্থাৎ, নিজের চুল, নখ, গোঁফ ইত্যাদি কাটবে না; বরং তা কুরবানীর দিন কাটবে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
أمرت بيوم الأضحى جعله الله عيدا لهذه الأمة. قال له رجل :يا رسول الله! أرأيت إن لم أجد إلا منيحة أنثى أفأضحي بها؟ قال-لا، ولكن خذ من شعرك وأظفارك وتقص شاربك وتحلق عانتك، فذلك تمام أضحيتك.
অর্থাৎ, আমি কুরবানীর দিন সম্পর্কে আদিষ্ট হয়েছি (অর্থাৎ, এ দিবসে কুরবানী করার আদেশ করা হয়েছে।) আল্লাহতা’আলা তা এ উম্মতের জন্য ঈদ হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। এক ব্যক্তি আরজ করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! যদি আমার কাছে শুধু একটি মানীহা থাকে অর্থাৎ, যা শুধু দুধপানের জন্য দেওয়া হয়েছে, আমি কি তা কুরবানী করবো? আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না; বরং সে দিন তুমি তোমার চুল কাটবে (মুন্ডাবে বা ছোট করবে), নখ কাটবে,মোচ এবং নাভীর নিচের পশম পরিষ্কার করবে। এটাই আল্লাহর কাছে তোমার পূর্ণ কুরবানী বলে গণ্য হবে। (মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং-৬৫৭৫; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস নং-৭৭৩; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-২৭৮৯; সুনানে নাসায়ী, হাদীস: ৪৩৬৫)
অর্থাৎ, যারা কুরবানী করতে সক্ষম নয় তারাও যেন মুসলমানদের সাথে ঈদের আনন্দ ও খুশি উদযাপনে অংশীদার হয়। তারা এগুলো কর্তন করে ও পরিপূর্ণ সওয়াবের অধিকারী হবে। অনুরূপভাবে হাজীদের সাদৃশ্য অবলম্বনকারী হবে।
৩. সিয়াম তথা রোযা পালন করা
মুসলমানের জন্য উচিত হবে যিলহজ্জ মাসের এই মুবারক দিনগুলোতে যত বেশি সম্ভব সিয়াম পালন করা তথা রোযা রাখা। সাওম আল্লাহর অতি প্রিয় আমল।
হাদীসে কুদসীতে সিয়ামকে আল্লাহ নিজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছেন। আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহ বলেছেন, সিয়াম ছাড়া আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই তার নিজের জন্য; কারণ, তা (সিয়াম) শুধু আমার জন্য। তাই আমিই এর প্রতিদান দেব। সিয়াম ঢাল স্বরূপ।’ (বুখারী-১৯০৪; মুসলিম-২৭৬২)
ঈদের দিন ছাড়া বাকি নয় দিন রোযা রাখা
আশারায়ে যিলহজ্জের আরেকটি বিশেষ আমল হল, ঈদুল আযহার দিন ছাড়া প্রথম নয় দিন রোযা রাখা। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই নয়টি দিবসে (যিলহজ্জ মাসের প্রথম নয় দিন) রোযা রাখতেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-২৪৩৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-২২২৩৪;সুনানে নাসায়ী, হাদীস নং-২৪১৬)
ইমাম নববী রহিমাহুল্লাহ বলেন, এসব দিনে সাওম পালন করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ মুস্তাহাব। কোনো কোনো দেশের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে মহিলাদের মাঝে একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে, যিলহজ্জ মাসের সাত, আট ও নয় তারিখে সাওম পালন করা সুন্নত। কিন্তু সাওমের জন্য এ তিন দিনকে নির্দিষ্ট করার কোনো প্রমাণ বা ভিত্তি নেই। যিলহজ্জের ১ থেকে ৯ তারিখে যে কোনো দিন বা পূর্ণ নয় দিন সাওম পালন করা যেতে পারে। অন্য হাদীসে হযরত হাফসা রা. বর্ণনা করেন-
أربع لم يكن يدعهن النبي صلى الله عليه وسلم-صيام عاشوراء والعشر وثلاثة أيام من كل شهر وركعتين قبل الغداة.
চারটি আমল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো ছাড়তেন না। আশুরার রোযা, যিলহজ্জের প্রথম দশকের রোযা, প্রত্যেক মাসের তিন দিনের রোযা, ফজরের আগে দুই রাকাত সুন্নত নামায। (সুনানে নাসায়ী, হাদীস :২৪১৫; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস নং-৬৪২২; মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস নং-৭০৪২;মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-২৬৩৩৯)
বিশেষভাবে নয় তারিখ তথা আরাফার দিনে রোযা রাখা
যিলহজ্জের প্রথম নয় দিনের মধ্যে নবম তারিখের রোযা সর্বাধিক ফযীলতপূর্ণ। সহীহ হাদীসে এই দিবসের রোযার ফযীলত বর্ণিত হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
صيام يوم عرفة أحتسب على الله أن يكفر السنة التي بعده والسنة التي قبله.
আরাফার দিনের (নয় তারিখের) রোযার বিষয়ে আমি আল্লাহর নিকট আশাবাদী যে, তিনি এর দ্বারা বিগত একবছর ও আগামী বছরের গুনাহ মিটিয়ে দিবেন। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১১৬২; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-২৪২৫; তিরমিযী, হাদীস নং-৭৪৯; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-১৭৩০)
আরেক হাদীসে এসেছে-
من صام يوم عرفة غفر له سنتين متتابعتين.
যে ব্যক্তি আরাফার দিন রোযা রাখবে তার লাগাতার দুই বছরের গুনাহ ক্ষমা করা হবে। (মুসনাদে আবু ইয়ালা,হাদীস নং-৭৫৪৮; মাজমাউয যাওয়াইদ, হাদীস নং-৫১৪১)
যারা যিলহজ্জের নয় রোযা রাখতে সক্ষম হবে না তারা যেন অন্তত এই দিনের রোযা রাখা থেকে বঞ্চিত না হয়।আল্লাহ তা’আলা আশারায়ে যিলহজ্জের মতো অন্যান্য বিশেষ বৈশিষ্ট্যমন্ডিত দিনগুলোতে ইবাদত-বন্দেগী করার তাওফীক দিন। আমীন।
৪. সালাত তথা নামায কায়েম করা
বছরের প্রত্যেক দিনই গুরুত্বসহ পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা জরুরী। এ দশদিনে তার গুরুত্ব আরো বেড়ে যায়। তাই এ দিনগুলোতে আমাদের সবার চেষ্টা করা উচিত ফরয সালাতগুলো জামাতে আদায় করতে। কেননা সালাত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ, সম্মানীত ও মর্যাবান আমল। পাশাপাশি আরও চেষ্টা করা দরকার বেশি বেশি নফল সালাত আদায় করতে। কারণ, নফল সালাতের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর নৈকট্য হাসিল রতে পারে।
হযরত আবূ হুরাইরা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার কোনো অলির সঙ্গে শত্রুতা রাখে, আমি তার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করি। আমার বান্দা ফরয ইবাদতের চাইতে আমার কাছে অধিক প্রিয় কোনো ইবাদতের মাধ্যমে আমার নৈকট্য লাভ করতে পারে না। আমার বান্দা নফল ইবাদত দ্বারাই সর্বদা আমার নৈকট্য অর্জন করতে থাকে। এমনকি অবশেষে আমি তাকে আমার এমন প্রিয়পাত্র বানিয়ে নেই যে, আমি তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শুনে। আমি তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দেখে। আর আমিই তার হাত হয়ে যাই, যা দিয়ে সে ধরে। আমি তার পা হয়ে যাই, যা দিয়ে সে চলে। সে আমার কাছে কোনো কিছু চাইলে আমি অবশ্যই তাকে তা দান করি। আর যদি সে আমার কাছে আশ্রয় চায় আমি তাকে অবশ্যই আশ্রয় দেই।
আমি যে কোনো কাজ করতে চাইলে তাতে কোনো রকম দ্বিধা-সংকোচ করি না, যতটা দ্বিধা-সংকোচ করি মুমিন বান্দার প্রাণ হরণে। সে মৃত্যুকে অপছন্দ করে থাকে অথচ আমি তার বেঁচে থাকাকে অপছন্দ করি।’ (বুখারী, হাদীস নং-৬৫০২)
৫. দান-সদকা করা
এ দিনগুলোতে যে আমলগুলো বেশি বেশি দরকার তার মধ্যে অন্যতম হলো সদকা। আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সদকা দিতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে ‘হে মুমিনগণ, আমি তোমাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা হতে ব্যয় কর, সে দিন আসার পূর্বে, যে দিন থাকবে না কোনো বেচাকেনা, না কোনো বন্ধুত্ব এবং না কোনো সুপারিশ। আর কাফিররাই যালিম।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-২৫৪)
আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,‘সদকা সম্পদকে কমায় না, ক্ষমার মাধ্যমে আল্লাহ বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধি করেন এবং কেউ আল্লাহর জন্য বিনয়ী হলে আল্লাহ তাকে উঁচু করেন।’ (মুসলিম-৬৭৫৭)
৬. তাকবীর, তাহমীদ ও তাসবীহ পড়া
এসব দিনে তাকবীর (আল্লাহু আকবার), তাহমীদ (আলহামদুলিল্লাহ), তাহলীল (লা ইলাহা ইলাল্লাহ) ও তাসবীহ (সুবহানাল্লাহ) পড়া সুন্নত। এ দিনগুলোয় যিকির-আযকারের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে, হাদীসে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবন উমর রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘এ দশ দিনে নেক আমল করার চেয়ে আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয় ও মহান কোনো আমল নেই। তাই তোমরা এ সময়ে তাহলীল (লা-ইল্লাহা ইলাল্লাহ), তাকবীর (আল্লাহু আকবার) ও তাহমীদ (আল-হামদুলিল্লাহ) বেশি বেশি করে পড়।’ (বাইহাকী, শুআবুল ঈমান-৩৪৭৪; মুসনাদ আবী আওয়ানা-৩০২৪)
উল্লেখ্য, বর্তমানে তাকবীর হয়ে পড়েছে একটি পরিত্যাক্ত ও বিলুপ্তপ্রায় সুন্নত। আমাদের সকলের কর্তব্য এ সুন্নতের পুনর্জীবনের লক্ষ্যে এ সংক্রান্ত ব্যাপক প্রচারণা চালানো। যিলহজ্জ মাসের সূচনা থেকে আইয়ামে তাশরীক শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ তাকবীর তথা আল্লাহু আকবার পাঠ করা সকলের জন্য ব্যাপকভাবে মুস্তাহাব। তবে বিশেষভাবে আরাফা দিবসের ফজরের পর থেকে মিনার দিনগুলোর শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ, যেদিন মিনায় পাথর নিক্ষেপ শেষ করবে সেদিন আসর পর্যন্ত প্রত্যেক সালাতের পর এ তাকবীর পাঠ করার জন্য বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ ও আলী রাদিআল্লাহু আনহুমা থেকে এ মতটি বর্ণিত। ইবন তাইমিয়া রহ. একে সবচেয়ে বিশুদ্ধ মত বলেছেন। উল্লেখ্য, যদি কোনো ব্যক্তি ইহরাম বাঁধে, তবে সে তালবিয়ার সাথে মাঝে মাঝে তকবীরও পাঠ করবে। হাদীস দ্বারা এ বিষয়টি প্রমাণিত। (মজমুয়ায়ে ফাতাওয়া ইবন তাইমিয়াহ: ২৪/২২০)
তাকবীরে তাশরীক
জিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখের ফজর থেকে ১৩ তারিখের আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরয নামাযের পর একবার তাকবীর বলা ওয়াজিব। পুরুষের জন্য আওয়াজ করে, আর মহিলাদের জন্য নীরবে। (সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৩৮০৫, সুনানে দারা কুতনী: ২/২৯৫, মাবসূত: ৪/৬)
তাকবীরের শব্দগুলো নিম্নরূপ
اَللهُ أَكْبَرُ، اَللهُ أكْبَرُ، لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ، وَاللهُ أَكْبَرُ، اَللهُ أَكْبَرُ وَلِله الحَمْدُ
উচ্চারণ: আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।
৭. পশু কুরবানী করা
এই দশদিনের অন্যতম প্রিয় আমল হলো কুরবানী। কুরবানীর পশু জবাই ও গরিবদের মধ্যে এর গোশত বিতরণের মাধ্যমে আল্লাহর বিশেষ নৈকট্য লাভ হয়। এর দ্বারা গরিবদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ পায় এবং তাদের কল্যাণ সাধন হয়। তাই এ দিনগুলোর দশম দিন সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য কুরবানী করা ওয়াজিব। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর নবীকে কুরবানী করতে নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে,
فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ
আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করুন ও কুরবানী করুন।’ (সূরা আল-কাউসার, আয়াত-০২)
স্বচ্ছল ব্যক্তির জন্য কুরবানী করা
বিধায় ১০, ১১ অথবা ১২ ই জিলহজ্জের যে কোন একদিন, কোন ব্যক্তির মালিকানায় যদি নিত্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ,অথবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা বা এর সমমূল্যের সম্পদ থাকে, তাহলে তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। পুরুষ-মহিলা সকলের উপরই এ বিধান প্রযোজ্য। (ফাতওয়া শামী-৯/৪৫৩-৪৫৭ ফাতওয়া আলমগীরী-৫/২৯২, সুনানে ইবনে মাজাহ-২২৬)
ফযীলত
عن زيد بن أرقم، قال: قال أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم: يا رسول الله ما هذه الأضاحي؟ قال: ্রسنة أبيكم إبراهيمগ্ধ قالوا: فما لنا فيها يا رسول الله؟ قال: ্রبكل شعرة، حسنةগ্ধ قالوا: ” فالصوف؟ يا رسول الله قال: ্রبكل شعرة من الصوف، حسنةগ্ধ
অর্থাৎ, যায়েদ বিন আরকাম রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবাগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এ সকল কুরবানীর ফযীলত কি? উত্তরে তিনি সা. বললেন-তোমাদের জাতির পিতা ইবরাহীম আ. এর সুন্নাত।
তাঁরা রা. পুনরায় আবার বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! তাতে আমাদের জন্য কী সওয়াব রয়েছে? উত্তরে তিনি সা. বললেন-কুরবানীর পশুর প্রতিটি চুলের বিনিময়ে একটি সওয়াব রয়েছে। তাঁরা রা. আবারো প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! ভেড়ার লোমের কি হুকুম? (এটাতো গণনা করা সম্ভব নয়), তিনি সা. বললেন-ভেড়ার লোমের প্রতিটি চুলের বিনিময়ে একটি সওয়াব রয়েছে। (সুনানে ইবনে মাজাহ-২২৬)
কঠোর হুশিয়ারী
أخرجه الإمام ابن ماجه بالسند المتصل في سننه عن أبي هريرة أن رسول الله صلى الله عليه و سلم قال-من كان له سعة ولم يضح فلا يقربن مصلانا
অনুবাদঃ আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করলো না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটেও না আসে।
(সুনানে ইবনে মাজাহ-২২৬)
৮. একনিষ্ঠ মনে তওবা
তওবার অর্থ প্রত্যাবর্তন করা বা ফিরে আসা। যে সব কথা ও কাজ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অপছন্দ করেন তা বর্জন করে যেসব কথা ও কাজ তিনি পছন্দ করেন তার দিকে ফিরে আসা। সাথে সাথে অতীতে এ ধরণের কাজে লিপ্ত হওয়ার কারণে অন্তর থেকে অনুতাপ ও অনুশোচনা ব্যক্ত করা। যিলহজ্জের শুভাগমনের আগে সবচে বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার এ তওবা তথা সকল গুনাহ থেকে ফিরে আসার প্রতি। স্বার্থক তওবা সেটি যার মধ্যে তিনটি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। যথা-
ক. গুনাহটি সম্পূর্ণভাবে বর্জন করা
খ. গুনাহের জন্য অনুতপ্ত হওয়া
গ. এই গুনাহটি ভবিষ্যতে না করার সংকল্প করা
বাস্তবেই এটি তওবার সুবর্ণ সময়। দয়াময় খোদা এ সময় বেশি বেশি তওবার তাওফীক দেন এবং অধিক পরিমাণে বান্দার তওবা কবুল করেন। তিনি ইরশাদ করেন,
فَأَمَّا مَنْ تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا فَعَسَى أَنْ يَكُونَ مِنَ الْمُفْلِحِينَ
‘তবে যে তাওবা করে ছিল, ঈমান এনেছিল এবং সৎকর্ম করে ছিল, আশা করা যায় সে সাফল্য অর্জনকারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ (কাসাস: ৬৭)
তিনি আরও ইরশাদ করেন,
قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَى أَنْفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا مِنْ رَحْمَةِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ
‘বল, ‘হে আমার বান্দাগণ, যারা নিজদের উপর বাড়াবাড়ি করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। অবশ্যই আল্লাহ সকল পাপ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (যুমার: ৫৩)
৯. এই সুবর্ণ সুযোগটাকে কাজে লাগাতে দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করা
সবার উচিত এই দিনগুলোকে পুণ্যময় কাজ ও কথায় সুশোভিত করার দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করা। যে ব্যক্তি কোনো কাজের সংকল্প করে আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন। তার জন্য সাহায্যকারী উপায় ও উপকরণ প্রস্তুত করে দেন। যে আল্লাহর সঙ্গে সত্যবাদিতা দেখায় আল্লাহ তাকে সততা ও সফলতায় ভূষিত করেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَإِنَّ اللَّهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِينَ
‘আর যারা আমার পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, তাদেরকে আমি অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করব। আর নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সাথেই আছেন।’ (সূরা আ‘নকাবূত: ৬৯)
১০. গুনাহ থেকে দূরত্ব অবলম্বন করা
সৎ কর্মের মাধ্যমে যেমন আল্লাহর নৈকট্য অর্জিত হয়, গুনাহের কাজের মাধ্যমে তেমন আল্লাহ থেকে, আল্লাহর রহমত ও করুণা থেকে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। মানুষ তার নিজের করা অপরাধের কারণে কখনো আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয়। তাই আমরা যদি অপরাধ মার্জনা এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তির প্রত্যাশী হই, তাহলে এ দিনগুলোতে এবং এর শিক্ষা কাজে লাগিয়ে বছরের অন্য দিনগুলোতে গুনাহ পরিত্যাগ করতে হবে। কেউ যখন জানতে পারেন কী বড় অর্জনই না তার জন্য অপেক্ষা করছে, তার জন্য কিন্তু যে কোনো কষ্ট সহ্য করা সহজ হয়ে যায়।
বিশেষ আকুতি
আমরা আগেই বলেছি এবং হাদীসের দ্বারা বুঝা যায় যে, এই দশ দিনের যে কোনো আমল চাই নফল নামায-রোযা হোক বা যিকির-তাহাজ্জুদ, তা আল্লাহর নিকট খুবই প্রিয় ও অতি পছন্দনীয়। তাই যে কোনো নফল ইবাদত যেমন নামায-রোযা, যিকির-তাহাজ্জুদ, দান-খয়রাত ইত্যাদি এই দশ দিনে করা হলে তার ফযীলত ও মর্যাাদা বছরের অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি পাওয়া যাবে। তাই এই ক’দিন সাধ্যমতো নফল ইবাদতের প্রতিও মনোযোগী হওয়া উচিত।
সুতরাং হে মুসলিম ভাই ও বোন, আপনি এ দিনগুলোকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে সচেষ্ট হোন। সময় চলে যাওয়ার পর আফসোস না করতে চাইলে যিলহজ্জ মাস আসার আগেই এতে অর্জনের জন্য প্রস্তুতি নিন।