‘আশরায়ে যিলহজ্জ’ বছরের শ্রেষ্ঠ দশক হবার কারণ
১. আল্লাহ তা‘আলা এর কসম করেছেন- আল্লাহ তা‘আলা যখন কোনো কিছুর কসম করেন তা কেবল তার শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদাই প্রমাণ করে । কারণ, মহা সত্তা শুধু মহা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েরই কসম করেন। যেমন স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা এই দশকের সম্মান ও পবিত্রতা প্রকাশান্তে এই দশকের রজনীগুলোর নামে শপথ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে,
والفجر، وليال عشر
শপথ ভোরবেলার, শপথ দশ রাত্রির। (সূরা ফজর: ১-২)
আর এখানে দশ রাত্রির দ্বারা যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ রাতকেই বুঝানো হয়েছে। হাফেয ইবনে কাসীর রাহ. বলেন, এটিই বিশুদ্ধ মত। (তাফসীরে ইবনে কাসীর ৪/৫৩৫-৫৩৬)
তাই অনেক ওলামায়ে কেরামের মতে পুরো বছরের ‘সর্বশ্রেষ্ঠ দশক’ হল আশরায়ে যিলহজ্জ। রমযানের শেষ দশকের চেয়েও যার ফযীলত ও গুরুত্ব বেশি। কেননা যিলহজ্জের এই প্রথম দশকে এমন দু’টি ইবাদত রয়েছে যা পুরো বছরের অন্য কোনো সময় আদায় করা সম্ভব নয়। এমনকি রমযানেও নয়।
এই দু’টি ইবাদতের জন্য আল্লাহ তা’আলা আশরায়ে যিলহজ্জকেই নির্বাচন করেছেন। এই দু’টি ইবাদতের একটি হল হজ্জ, আর দ্বিতীয়টি কুরবানী। আর কুরবানী যদিও ১১ ও ১২ যিলহজ্জের দেওয়া যায়, কিন্তু বছরের অন্য কোনোদিন এই ওয়াজিব কুরবানী সম্ভব নয়। এই ক্ষেত্রে রমযানের শেষ দশকের চেয়ে আশরায়ে যিলহজ্জের হজ্জ ও কুরবানীর রয়েছে বাড়তি ফযীলত।
আবার অনেক ওলামায়ে কেরামের মতে রমযানের শেষ দশকই উত্তম। কারণ তাতে রয়েছে হাজার মাসের চাইতে উত্তম লাইলাতুল কদরের মতো মহিমান্বিত রজনী। ওলামায়ে কেরামের এই দু’টি মতের সমন্বয় সাধন করতে গিয়ে অনেক মুহাক্কিক আলেম বলেছেন, আশরায়ে যিলহজ্জের দিন ও রমযানের শেষ দশকের রাত্রি উত্তম। এভাবে উভয় দলীলের মাঝে সমন্বয় করা যেতে পারে। (তাফসীরে ইবনে কাসীর ৩/২৩৯; ইসল্লাহী খুতবাত ২/১২২-১২৪; লাতায়িফুল মাআরিফ ২৯৫-২৯৬)
যাই হোক, রমযানের পরে আশরায়ে যিলহজ্জের চেয়ে শ্রেষ্ঠতম কোনো দিন নেই-এটা পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় এবং এতে সকলেই একমত। হযরত জাবের রা. হতে বর্ণিত একটি সহীহ হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, (তরজমা)‘আশরায়ে যিলহজ্জের দিনের চেয়ে কোনো দিনই আল্লাহর নিকট উত্তম নয়।’ (সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস ৩৮৫৩)
আর যিলহজ্জের প্রথম দশকের মধ্যে শেষ দু’দিন নবম তারিখ ও দশম তারিখ হল পুরো বছরের সর্বোৎকৃষ্ট দিন। যাকে হাদীসের ভাষায় ইয়াওমে আরাফা ও ইয়াওমে নাহর বলা হয়। (সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৩৮৫৩; মুসনাদে আহমাদ, ৪/৩৫০ হাদীস নং-১৯০৭৫)
এছাড়া বিভিন্ন হাদীসে এই দশ দিনের বিশেষ কিছু আমলের কথাও বলা হয়েছে। তাই এ বিষয়ে পূর্ণ আত্মনিয়োগ করা চাই। কেননা কুরআন-সুন্নাহে আশরায়ে যিলহজ্জের এই আলাদা গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্যের দরুণ এ দশটি দিন হল অর্জনের ভরপুর মৌসুম। এই দিনগুলোতে করা ইবাদত-বন্দেগী আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয়।
হযরত ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আশরায়ে যিলহজ্জের নেক আমলের চেয়ে আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় অন্য কোনো দিন (এর কোনো আমল) নেই।’ (সহীহ বুখারী হাদীস নং-৯৬৯; মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং-১৯৬৮)
এই হাদীস দ্বারা স্পষ্ট বোঝা যায়, আশরায়ে যিলহজ্জের যে কোনো নেক আমলের চাইতে উত্তম কোনো আমল হতে পারে না।
যেহেতু সাহাবায়ে কেরাম জানতেন যে, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের চেয়ে উত্তম কোনো আমল নেই তাই আশরায়ে যিলহজ্জের আমলের শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা শোনার পর তারা আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘জিহাদও কি এই দশ দিনের আমলের চেয়ে উত্তম নয়?’ নবীজী জবাব দিলেন, না। জিহাদও উত্তম নয়।
তবে হ্যাঁ, সেই ব্যক্তির জিহাদ এই দশদিনের আমলের চেয়ে উত্তম হতে পারে যে স্বীয় জান-মাল নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের উদ্দেশ্যে বের হল। অতঃপর জিহাদের ময়দানে জান-মাল সবকিছু বিসর্জন করে দিয়েকিছু নিয়েই ঘরে ফিরে এল না। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৯৬৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-২৪৩৮; ডতরমিযী, হাদীস নং-৭৫৮; ফাতহুল বারী ২/৫৩১-৫৩২)
এর দ্বারা স্পষ্ট বোঝা গেল যে, এই দশ দিনে করা যে কোনো নেক আমল সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বোত্তম আমল। পুণ্য অর্জনের এর চেয়ে উপযোগী সময় আর কী হতে পারে?
২. এসব দিনে আল্লাহ তাঁর জিকিরে র প্রবর্তন করেছেন-আল্লাহ তা‘আ বলেন ‘যেন তারা নিজদের কল্যাণের স্থানসমূহে হাযির হতে পারে এবং তিনি তাদেরকে চতুষ্পদ জন্তু থেকে যে রিজিক দিয়েছেন তার ওপর নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে।’
(সূরা আল-হজ্জ, আয়াত-২৮)
জমহূর উলামার মতে, আয়াতে নির্দিষ্ট দিনসমূহ বলে যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিনকে বুঝানো হয়েছে। এটিই ইবন উমর ও ইবন আব্বাস রাদিআল্লাহু আনহুমার মত।
৩. এই দিনগুলোর মধ্যে রয়েছে আরাফার দিন-আরাফার দিন হলো বড় হজ্জের দিন। এটি ক্ষমা ও মাগফিরাতের দিন। জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও নাজাতের দিন। যিলহজ্জের এই দশকে যদি ফযীলতের আর কিছু নাও থাকত তবে এ দিবসটিই তার মর্যাদার জন্য যথেষ্ট হত। এ দিনের ফযীলত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
الْحَجُّ عَرَفَةُ.
‘আরাফা দিবসই হজ্জ’। (তিরমিযী-৮৯৩; নাসায়ী-৩০১৬)
৪. এতে রয়েছে কুরবানীর দিন-কোনো কোনো আলিমের মতে কুরবানীর দিনটি বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ দিন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহর কাছে সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ দিন হলো কুরবানীর দিন অতপর স্থিরতার দিন’। (অর্থাৎ, কুরবানীর পরবর্তী দিন। কারণ, সেদিন মানুষ কুরবানী ইত্যাদির দায়িত্ব পালন শেষ করে সুস্থির হয়।) (নাসায়ী, হাদীস নং-১০৫১২, সহীহ ইবন খুযাইমা, হাদীস নং-২৮৬৬)
৫. এ দিনগুলোতে মৌলিক ইবাদতগুলোর সমাবেশ ঘটে। হাফেয ইবন হাজর রহিমাহুল্লাহ তদীয় ফাতহুল বারী গ্রন্থে বলেন, ‘যিলহজ্জের দশকের বৈশিষ্ট্যের কারণ যা প্রতীয়মান হয় তা হলো, এতে সকল মৌলিক ইবাদতের সন্নিবেশ ঘটে। যথা-সালাত, সিয়াম, সদকা, হজ্জ ইত্যাদি। অন্য কোনো দিন এতগুলো ইবাদতের সমাবেশ ঘটে না।’ (ফাতহুল বারী-২/৪৬০)
এ হাদীসগুলোর মর্ম হল, বছরে যতগুলো মর্যাদাপূর্ণ দিন আছে তার মধ্যে এ দশ দিনের প্রতিটি দিনই সর্বোত্তম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দিনসমূহে নেক আমল করার জন্য তাঁর উম্মতকে উৎসাহিত করেছেন। তাঁর এ উৎসাহ প্রদান এ দিনের ফযীলত প্রমাণ করে । রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দিনগুলোতে বেশি বেশি করে তাহলীল ও তাকবীর পাঠ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন ওপরে ইবন উমর রাদিআল্লাহু আনহু বর্ণিত হাদীসে উল্লেখ হয়েছে।
ইবন রজব রহিমাহুল্লাহ বলেন, উপরোক্ত হাদীসগুলো থেকে বুঝা যায়, নেক আমলের মৌসুম হিসেবে যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশক হল সর্বোত্তম, এ দিবসগুলোয় সম্পাদিত নেক আমল আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়। হাদীসের কোনো কোনো বর্ণনায় أَحَبُّ (‘আহাব্বু’ তথা সর্বাধিক প্রিয়) শব্দ এসেছে আবার কোনো কোনো বর্ণনায় أَفْضَلُ (‘আফযালু’ তথা সর্বোত্তম) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।
অতএব এ সময়ে নেক আমল করা বছরের অন্য যে কোনো সময়ে নেক আমল করার থেকে বেশি মর্যাদা ও ফযীলতপূর্ণ। এজন্য উম্মতের অগ্রবর্তী পুণ্যবান মুসলিমগণ এ সময়গুলোতে অধিকহারে ইবাদতে মনোনিবেশ করতেন। তাই সর্বযুগের প্রতিটি মুসলমানের জন্য উচিত ইবাদতের মৌসুমগুলো, বিশেষকরে এ দশ দিন সুন্দর প্রস্তুতি ও উত্তম আমল-আখলাকের মাধ্যমে অতিবাহিত করা।