হজ্জ পরবর্তী জীবন কেমন হওয়া উচিত
হজ্জ ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। যে পাঁচটি বিষয়ের উপর ইসলামের মূল ভিত্তি, তার পঞ্চমটি হল হজ্জ। তবে নামায, রোযা থেকে হজ্জের বিধানটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কেননা, এটি মুসলমানের উপর প্রতিদিন অথবা প্রতি বছর ফরয হয় না; বরং জীবনে মাত্র এক বারই ফরয হয়ে থাকে।
আর বস্তুত হজ্জ পালন আল্লাহর প্রতি বান্দার অকৃত্রিম ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। হজ্জের পুরো ব্যাপারটিই মূলত আল্লাহর এক অনুগত বান্দা নবী হযরত ইবরাহীম আ.-এর স্মৃতিচারণ। যিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা বিভিন্ন কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন পূর্ণ সফলতার সঙ্গে। পবিত্র কুরআন মজীদে যার বর্ণনা এসেছে। আল্লাহর প্রতি তাঁর এই অকৃত্রিম ভালোবাসা আর মহা ত্যাগ আল্লাহর দরবারে এতই কবুল হয়েছিল যে, পরবর্তী নবীর উম্মতের জন্যও সে পাগলপারা বান্দার রূপ ও বেশ-ভূষা ধারণ করা ইবাদতের অংশ বানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আর তাই বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ থেকে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ মানুষ ভালোবাসার টানে, যিয়ারতে বাইতুল্লাহর ঈমানী আকর্ষণে ছুটে আসে হজ্জ পালনে। ইযার পরনে গায়ে চাদর জডড়য়ে ফকীরের বেশে “লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইক” ধ্বনিতে মুখরিত থাকে সবখানে। যাদের অন্তর পবিত্র, যাদের অর্ন্তদৃষ্টি আছে, তারা দেখেন আল্লাহর কুদরত, তাঁর অপার মহিমা, তাদের মনে জাগে বার বার হাযিরীর সাধ। আর যাদের তা নেই, হৃদয় যাদের কলুষিত, তাদেরও হয় অনুভূতি, তারাও পায় অভাবিত স্বাদ। এ সময়ে যেন বয়ে বেঙায় খোদার করুণার ফল্গুধারা, যার পরশে সৌভাগ্যবানরা হয়ে ওঠেন আত্মহারা।
কিন্তু এই সৌভাগ্য তো তাদেরই নসীব হয়, যাদেরকে আল্লাহ তা’আলা ভালোবাসেন, যাদেরকে তিনি দিয়েছেন তাঁর ঘর যিয়ারত করার সামর্থ্য। নামায-রোযার মতো এই ইবাদতটি সাধারণ মুসলমানের উপর আবশ্যকীয় নয়। এর জন্য রয়েছে বিশেষ কিছু শর্তাবলি। হজ্জের ফযীলত সংক্রান্ত এ সহীহ হাদীসখানা সবারই জানা ‘যে হজ্জ করে এবং (তাতে সবধরণের) অশ্লীল কথা ও কাজ এবং গুনাহ-পাপাচার থেকে বিরত থাকে সে সদ্যজাত শিশুর মতো (নিষ্পাপ) হয়ে যায়। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং- ১৫২১)
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এই ক্ষমা ও মাগফিরাতের দাবি হচ্ছে, বান্দার তরফ থেকেও পাপমুক্ত জীবন যাপনে সচেষ্ট হওয়া। এটা এই মহাপুরস্কারের প্রকৃত মূল্যায়ন। পাপমুক্ত জীবন মানে কী? প্রসঙ্গটি বেশ বিস্তৃত। এর জন্য বুঝতে হবে পাপ মানে কী। সহজ ভাষায় ইসলামের অবশ্যপালনীয় বিধি-বিধান লঙ্ঘন করাই পাপ। তাহলে ইসলামের বিধি-বিধানের পরিধি যত বড় পাপ-পুণ্যের ক্ষেত্রও তত বিস্তৃত।
ইসলাম তো অন্যান্য ধর্মীয় মতবাদের মতো নিছক আচার ও আনুষ্ঠানিকতা সর্বস্ব কোনো ধর্ম নয়। ইসলাম হচ্ছে মানব-জীবনের সকল ক্ষেত্রের জন্য আলোকবর্তিকা, যে ক্ষেত্রগুলোর প্রধান প্রধান কিরোনাম এই ‘আকাইদ’ (বিশ্বাস), ‘ইবাদাত’ (উপাসনা) ‘মুআমালা’ (লেনদেন) ‘মুআশারা’ (সমষ্টিগত জীবনের নীতি ও বিধান) ‘আখলাক’ (স্বভাব-চরিত্র) ইত্যাদি। এই সবগুলো ক্ষেত্রেই রয়েছে আল্লাহর বিধান ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ। এরই নাম দ্বীন ও শরীয়ত। এরই অনুসরণ পুণ্য আর অন্যথা পাপ।
সুতরাং পুণ্যময় পাপমুক্ত জীবন-যাপনের অর্থ জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান ও আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহর অনুসরণ।
যাঁরা আল্লাহর ঘর সচক্ষে দর্শন করেছেন এবং তাওয়াফের সৌভাগ্য লাভ করেছেন, যারা আল্লাহর রাসূলের রওযায় সশরীরে উপস্থিত হয়েছেন এবং দরুদ ও সালাম পেশ করেছেন তাদের তো নিশ্চয়ই এই প্রেরণা জাগ্রত হয়েছে যে, “আগামী জীবন ইনশাআল্লাহ আল্লাহর বিধান মোতাবেক ও রাসূলের সুন্নাহ অনুযায়ী অতিবাহিত করব।” এই পবিত্র প্রেরণার সাথে যখন যুক্ত হবে সৎসাহস। আর যাত্রা আরম্ভ হবে নতুন জীবনের নতুন পথে, তখন আল্লাহর পক্ষ হতে নুসরতও হতে থাকবে। কা‘বার মালিকের প্রতিশ্রুতি, “যারা আমার (সন্তুষ্টির) পথে মুজাহাদা করবে আমি অবশ্যই তাদের আমার (সন্তুষ্টির) পথে পরিচালিত করব।” আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে কবুল করুন। আমিন।