বন্ধকালীন সময় মাদরাসা-ছাত্রদের করণীয়
(জামিয়াতুল আস’আদ আল ইসলামিয়া-ঢাকা এর ১৪৩৮/৩৯ হিজরী শিক্ষাবর্ষের ১ম সেমিস্টার পরীক্ষার ছুটি উপলক্ষে আয়োজিত বিশেষ মজলিশে জামিয়ার স্বনামধন্য পরিচালক হযরত মাওলানা মুফতী হাফীজুদ্দীন দা. বা. ছুটির দিনগুলোতে ছাত্রসমাজের যিম্মাদারী এবং করণীয়-বর্জনীয় প্রসঙ্গে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সারগর্ভ আলোচনা পেশ করেন। আকাবীরের পূর্ণ চিন্তা-চেতনা এবং আদর্শের প্রোজ্জ্বল প্রতীক এই মহান ব্যক্তির হৃদয়নিসৃত, অভিজ্ঞতালব্ধ আবেদনগুলো যেন কালের গর্ভে বিলীন হয়ে না যায় এবং উপস্থিত অনুপস্থিত সবাই উপকৃত হতে পারে এই উদ্দেশ্যে এ ক্ষুদ্র প্রয়াস।)
نحمده ونصلى على رسوله الكريم، اما بعد، قال الله تعالى فَلَوْلاَ نَفَرَ مِن كُلِّ فِرْقَةٍ مِّنْهُمْ طَآئِفَةٌ لِّيَتَفَقَّهُواْ فِي الدِّينِ وَلِيُنذِرُواْ قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُواْ إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ، وقال رسول الله صلى الله عليه وسلم : إنما الأعمال بالنيات، صدق الله العظيم و صدق رسوله النبي الكريم و نحن علي ذلك من الشاهدين والشاكرين والحمد لله رب العالمين-
প্রিয় ছাত্রভাইয়েরা!
অসংখ্য শুকিরয়া মহান আল্লাহ পাকের জন্য; যিনি আমাদেরকে সুস্থতার সাথে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পরীক্ষার মতো কঠিন একটি কাজ আঞ্জাম দেয়ার তাওফীক দিয়েছেন। আজ মাদরাসা ছুটি হচ্ছে, মাদরাসায় থাকাকালীন সময়ে তোমরা যেভাবে রুটিন মাফিক হিসাব করে গুরুত্বের সাথে সময়গুলো কাটিয়েছো, মনে রাখতে হবে বন্ধের দিনগুলোর গুরুত্বও কোন অংশে কম নয়। বরং মুমিনের প্রতিটি মুহূর্ত-সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এবং প্রতিটি মুহূর্তের হিসাব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আল্লাহর কাছে দিতে হবে। কাজেই হিসাব দেয়ার আগে নিজেই নিজের হিসাব নিয়ে আখেরাতের জন্য প্রস্তুতি নেয়া সৌভাগ্য ও সফলতার পরিচয়। খলিফাতুল মুসলিমীন হযরত উমর রাযি. বলেন, “তোমার থেকে হিসাব নেয়ার আগে নিজেই নিজের হিসাব লও, আর আমলনামা ওজন করার আগে নিজেই নিজের আমল ওজন করে নাও।” (হুজ্জাতল্লিাহিল বালেগা)
অতএব বন্ধের দিনগুলি হেলায়-খেলায়, আনন্দ-ফূর্তিতে কাটানোর সুযোগ আমাদের নেই। উপরন্তু আমরা হলাম ওয়ারিসে নবী। আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক বেশী। সুতরাং আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্যের অনুভূতি ও ইহসাস পয়দা করে উম্মতের দরদ ও ফিকির নিয়ে এখন থেকেই পুরোদমে কাজ করতে হবে। অন্যথায় আমাদের নিজেদের ঈমান-আমল রক্ষা করাই কঠিন হয়ে যাবে।
বাড়িতে যাওয়ার পূর্বে নিয়তের পরিশুদ্ধি
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন إنما اللأعمال بالنيات প্রতিটি আমলের প্রতিদান নিয়তের উপর নির্ভরশীল। (বুখারী শরীফ ১/২) মাদরাসা ছুটি হচ্ছে, বাড়িতে যাবে।যাওয়ার আগে নিয়ত ঠিক করে যাও। তাহলে বাড়িতে যাওয়াটাও তোমার ইবাদতে পরিণত হবে। বাড়িতে যাবে-
صلة الرحم এর নিয়তে, অর্থাৎ আত্মীয় স্বজনের খোঁজ খবর নেয়ার জন্য, তাদের হক আদায় করার জন্য। আবার বাড়ি থেকে আসার সময়ও নিয়ত ঠিক করে আস। ইলম, আমল শেখা ও আল্লাহকে পাওয়ার নিয়তে আস। তাহলে তোমার বাড়িতে যাওয়া এবং বাড়ি থেকে আসা দুটোই ইবাদত হিসাবে পরিগণিত হবে।
বাড়িতে যাওয়ার পর যিম্মাদারী
১. নিজের মামুলাত ঠিক রাখা। ২. সব ধরনের গুনাহের কাজ থেকে বিরত থাকা। ৩. পিতামাতার খেদমত করা। ৪. আত্মীয় স্বজনের হক আদায় করা। ৫. মহল্লাবাসী ও গ্রামের হক আদায় করা। ৬. মহিলাদের জন্য অবশ্যই বাড়িতে তালীমের ব্যবস্থা করা। ৭. এলাকার স্কুলের ছাত্রদের মাঝে দ্বীনের কাজ করা। ৮. এলাকার অন্যান্য লোকদের সাথে পরিচিত হওয়া। ৯. জনকল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণ করা। ১০. উলামায়ে কেরাম ও প্রাক্তন উস্তাদদের সাথে সাক্ষাত করা।
১. নিজের মামুলাত ঠিক রাখা
বড় দুঃখ লাগে আমাদের ছাত্রদের অবস্থা দেখলে, তারা মাদরাসায় থাকাবস্থায় মামুলাত হয়তো ঠিকমতো আদায় করে কিন্তু বাড়িতে যাওয়ার পর তাদের আমল ঠিক থাকে না। ঠিকমতো নামাজ পড়ে না, মসজিদে যায় না। তাই জরুরী হলো বাড়িতে যাওয়ার পরও নিজের মামুলাত ঠিক রাখা। এলাকায় আমলী পরিবেশ কায়েম করা। যাবতীয় যিম্মাদারী পালন করা এবং দ্বীনের ফিকির নিয়ে মেহনত করা।
২. সব ধরনের গুনাহের কাজ থেকে বিরত থাকা
এ দায়িত্ব শুধু নিজ এলাকায় নয়, সারা জীবনের জন্য, সব জায়গার জন্য। বিশেষ করে চোখ-কানের হেফাজত করা ও লজ্জাস্থানের হেফাজত করা। কেননা অধিকাংশ গুনাহ এ অঙ্গসমূহের মাধ্যমেই সংঘটিত হয়ে থাকে।
৩. পিতামাতার খেদমত করা
মনে রাখতে হবে, তাদের খেদমত দুই প্রকার-ক. উখরুবী খেদমত ও খ. দুনিয়াবী খেদমত
উখরুবী খেদমত
এই খেদমতটাই বড় ও প্রধান খেদমত। অর্থাৎ পিতামাতার ঈমান আকীদা সংশোধন, সুরা কেরাত শুদ্ধকরণ এবং নামাজ শেখানো। কারণ উখরুবী খেদমতের ফল চিরস্থায়ী, আর বৈষয়িক খেদমতের লাভ অস্থায়ী, সাময়িক। আলহামদুলিল্লাহ! আমি ছোট থেকেই মা এর উখরুবী খেদমত বেশী বেশী করতাম। যখন বাড়িতে যেতাম সময় পেলেই বলতাম মা! আপনার তাশাহ্হুদটা শোনান তো দেখি, ওমুক সুরাটা বলেন তো, দেখি কোথাও ভুল হয় নাকি। এভাবে কোথাও ভুল হলে শুদ্ধ করে দিতাম। নামাজের পদ্ধতিগুলো দেখতাম। আমার মাও আমার জন্য অপেক্ষা করতেন। আগে থেকে ঠিক করে রাখতেন যে, এবার আসলে এই এই বিষয়গুলো জেনে নেবো। অতপর যখন বাড়িতে যেতাম তখন জিজ্ঞাসা করে জেনে নিতেন।
দুনিয়াবী খেদমত
দুনিয়াবী খেদমতও করতে হবে। বাড়িতে যে কয়দিন থাকবে পিতা-মাতার দুনিয়াবী খেদমত করবে। তাদের কাজে সহযোগিতা করবে। তাদের কথানুযায়ী চলবে। রান্না-বান্নায় সাহায্য করবে। হাড়ি-পাতিলগুলো ধুয়ে দিবে। মা-বাবার ঘরটা পরিষ্কার করে দিবে। অযু গোসলের পানি তুলে দিবে। তাদের কাপড়-চোপড় ধুয়ে দিবে। দুঃখের সহিত বলতে হয়, আমাদের অনেক তালিবে ইলম আছে, বাড়িতে গেলে পিতা-মাতার কাপড় ধুয়ে দিবে তো দূরে থাক; নিজেরগুলোও নিজে ধৌত করে না। মাকে দিয়ে ধোয়ায়! এমন করবে না। তাদের সকল কাজে সার্বিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করবে। এর দ্বারা আল্লাহ তা’আলা ইলমের মাঝে নূর দান করবেন ইনশাআল্লাহ।
৪. আত্মীয় স্বজনের হক আদায় করা।
আত্মীয় স্বজনের হক আদায় করা, তাদের খোঁজখবর নেয়া। তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করা। তাদের ঈমান-আকীদা সংশোধন করা। নামাজ-রোজাসহ সব ইসলামী বিধি-বিধান শেখানো। ছাত্ররা আত্মীয়-স্বজনের ঈমানের খোঁজখবর নেয় না। তাইতো দেখা যায়, সে আলেম! কিন্তু তার চাচা আটরশীর পীরের মুরীদ, তার ভাই আহলে হাদীস বা জামাত শিবিরের কর্মী ইত্যাদি ভ্রান্ত আকীদায় জড়িত। তাই আত্মীয়-স্বজনের খোঁজখবর নিতে হবে। আমাদের অবহেলার কারণে আজ বিভিন্ন বাতিল ফেরকা ও ইহুদি খৃষ্টানরা তাদের ঈমান কেড়ে নিচ্ছে। ঈমান আকীদা বিনষ্ট করছে। তাই আমাদেরকে সজাগ থাকতে হবে।
৫. মহল্লাবাসী ও গ্রামের হক আদায় করা
এলাকার লোকদের মাঝে কিছু মেহনত করা। প্রতিদিন এলাকার মসজিদে কিছু ঈমান আকীদা ও দ্বীনি কথাবার্তা বলা। তালিমের ব্যবস্থা করা। তাদের সুরা কেরাত শেখানো ও শুদ্ধ করা। যে কয়জনই বসুক, তাদের নিয়েই দ্বীনি মুযাকারা করা।
৬. মহিলাদের জন্য অবশ্যই বাড়িতে তালীমের ব্যবস্থা করা
এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। মহিলারা দ্বীন সম্পর্কে জানে না বললেই চলে। তাই একটা সময় নির্ধারণ করে তাদেরকে নামায-রোযা, অযু-গোসল, পবিত্রতা ইত্যাদি বিষয়ে তালীমের ব্যবস্থা করা। মাহরাম মহিলাদেরকে সরাসরি পদ্ধতি দেখিয়ে দেয়া আর অন্যান্য মহিলাদেরকে পর্দার সাথে তাদের তালীমের ব্যবস্থা করা। এটা সকলের জন্য আবশ্যক। সবাইকে করতে হবে।
৭. স্কুলের ছাত্রদের মাঝে দ্বীনের কাজ করা
এলাকার স্কুলের ছাত্রদের মাঝে দ্বীনের কাজ করা। এর জন্য স্কুলের শিক্ষকদের সাথে আলোচনা করে একটা সময় বের করে -টিফিনের সময় হোক বা অন্য সময়- সকলকে একত্রিত করে দ্বীনের কিছু কথা বলা। ঈমান আকীদার মৌলিক বিষয়গুলো শেখানো। নামায-রোযার হুকুম ও পদ্ধতি শেখানো। ইসলাম সম্পর্কে মৌলিক ও স্পষ্ট ধারণা দেয়া, যাতে কোন ভ্রান্ত দল বা ধর্ম তাদেরকে বিভ্রান্ত করতে না পারে। আর এভাবেই তাদের মাঝে কাজ করতে হবে। নয়তো বড় হয়ে তারাই ধর্ম বিদ্বেষী ও নাস্তিকে পরিণত হবে। এজন্য ছোট থাকতেই তাদের ভেতর ইসলামের চেতনা ও আদর্শের বীজ বপন করতে হবে।
৮. এলাকার অন্যান্য লোকদের সাথে পরিচিত হওয়া
বাড়িতে যাওয়ার পর আমাদের গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি কাজ হলো এলাকার সকল স্তরের লোকদের সাথে পরিচিত হওয়া। সম্পর্ক স্থাপন করা। এলাকার সকল লোক তোমাকে চিনবে, তুমিও তাদেরকে চিনবে। চাই সে ভালো হোক বা মন্দ হোক। এলাকার মেম্বার, চেয়ারম্যন, এমপি-মন্ত্রী থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণ সকলের সাথে পরিচিত হবে। এই পরিচয় যেন এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ না থাকে যে শুধু আমি তাকে চিনি। বরং তিনিও আমাকে চিনবেন। তাদের কাছে আমার অবস্থান প্রকাশ করতে হবে। জায়গা বুঝে নিজের পরিচয় বড় করে প্রকাশ করতে হয়। এই পরিচয় হবে দ্বীনের জন্য। দ্বীনের এশায়াতের জন্য। দ্বীনের খাতিরে এই পরিচয় দেয়া কিবির নয়। বরং দ্বীনের অংশ। তাদের সাথে সালাম মুসাফাহা, কুশল বিনিময়, নম্রতা ও পারলে সামান্য খেদমত তথা চা পান খাওয়ানো ইত্যাদির মাধ্যমে পরিচিত হওয়ার পর্ব শুরু করতে হবে। কোরআন শরীফে দাঈ এর জন্য এটাও একটা কৌশল হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এভাবে প্রতি ছুটিতে টার্গেট করে যেতে হবে, এই ছুটিতে আমি নতুন দশ জন বা পনের জন ব্যক্তির সাথে পরিচিত হবো। তাদের মাঝে দ্বীনের ফিকির দিবো। তাদের মাঝে আকাবিরের চিন্তা চেতনা ছড়িয়ে দিবো। তাদের দ্বারা দ্বীনের কাজ করবো। এভাবে টার্গেট বানিয়ে কাজ করলে কাজের গতি বাড়বে। কাজের পরিধি বাড়ানো যাবে।
৯. জনকল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণ করা
এলাকায় অসহায়-গরীবদের খোঁজ-খবর নেয়া। এলাকার উন্নয়নমূলক কাজ যথা রাস্তা-ঘাট পুনঃনির্মাণ ইত্যাদি কাজে স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণের চেষ্টা করা। যতটুকু সম্ভব অংশগ্রহণের মাধ্যমে এলাকার ভাই-বোনদের সাথে পরিচিত হয়ে তাদের দ্বীনের দাওয়াত দেয়া। পরস্পর কারো মাঝে ঝগড়া-বিবাদ হলে মিমাংশা করার চেষ্টা করা।
১০. উলামায়ে কেরাম ও প্রাক্তন উস্তাদদের সাথে সাক্ষাত করা
এলাকার উলামায়ে কেরাম ও প্রাক্তন উস্তাদদের সাথে সাক্ষাত করা, তাদের খোঁজখবর নেয়া এবং দোয়া চাওয়া। দ্বীনের খেদমতের কারগুজারী শোনানো। সাথে সাথে বিভিন্ন মাদরাসায় অধ্যয়নরত ছাত্রদেরকে জমায়েত করে তাদের মাঝেও দ্বীনের ফিকির দেয়া। যাতে সকলেই সম্মিলিতবাবে দ্বীনের খেদমত করে।
সুতরাং বাড়িতে যাওয়াটা যেন আমার শুধুই বাড়িতে যাওয়া না হয়। বরং বাড়িতে যাওয়াটা যেন দ্বীনের কাজের জন্য হয়। বাড়িতে যাওয়া যেন দ্বীনের খাতিরে হয়। এই চেষ্টা করা। দ্বীনের ফিকির নিয়ে বাড়িতে যাওয়ার বড় ফায়দা হলো নিজের আমল ঠিক থাকে।
আর তালিবুল ইলমদের সর্বশেষ কাজ হলো ছুটি শেষে ঠিক সময়ে মাদরাসায় উপস্থিত হওয়া। এবং পড়ালেখায় মনোযোগী হওয়া। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে দ্বীনের জন্য কবুল করুন। সবাইকে দ্বীনের পথে অবিচল রাখুন। আমীন।
very good,,