শবে বরাতঃ পালনিয় ও বর্জনীয় আমল
মাওলানা মুহাম্মাদ আরমান সাদিক
‘শবে বরাত’ শব্দটি ফারসি। ‘শব’ অর্থ রজনী, রাত। ‘বরাত’ অর্থ ভাগ্য, সৌভাগ্য। বাংলায় এর অর্থ হল, ‘সৌভাগ্যের রজনী।’ আর ‘বরাত’ শব্দটি যদি আরবী-‘বারাআত’ এর বিকৃতরূপ হয়ে থাকে তাহলে অর্থ হবে, মুক্তির রজনী। শবে বরাত শব্দটি কুরআন হাদীস কোথাও পাওয়া যায় না, যাবেও না। কুরআন-হাদীসের কোথাও শবে বরাত শব্দটি না থাকায় এর কোন প্রমাণ নেই- এমন মনে করাটাও ঠিক না। কারণ এটি ফারসি শব্দ। তাই কুরআন-হাদীসে না থাকাটাই স্বাভাবিক। যেমন- নামাজ ও রোজা। শব্দ দু’টি কুরআন-হাদীসের কোথাও খুজে পাওয়া যাবে না। তাই বলে কি নামাজ রোজার কোন প্রমাণ নেই? নামাজ ও রোজা শব্দ দু’টিও ফারসি। আমরা উপমহাদেশের লোকেরা ‘সালাত’ কে নামাজ ও ‘সউম’ কে রোজা বলি। সালাত আদায় ও সউম পালনের আদেশ যেহেতু কুরআন-হাদীসে আছে, তাই শব্দ পরিবর্তনের কারণে নামাজ ও রোজাকে ভিত্তিহীন বলা যাবে না।
অনুরূপ শবে বরাত শব্দটি কুরআন হাদীসে না থাকলেও শবে বরাত বলতে আমরা যে দিনটিকে বুঝি তার কথা হাদীসে এসেছে। শবে বরাত হল আরবী শা’বান মাসের ১৫তম রজনী (অর্থাৎ ১৪ তারিখ দিবাগত রাত)। হাদীসে একে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শা’বান’ (অর্ধ-শা’বানের রাত অর্থাৎ ১৫ শা’বান) বলা হয়েছে। সুতরাং শবে বরাত শব্দ হাদীসে নাই এ দাবী তুলে এর ফজিলতকে একেবারে ভিত্তিহীন বলে দেয়া কখনই কাম্য নয়।
‘শবে বরাত‘ সৌভাগ্য বা মুক্তির রাত
হাদীসে শবে বরাতের ফজিলত সম্পর্কে যে ঘোষণা এসেছে তার প্রতি লক্ষ্য করলেই বুঝা যায়, এ রাত বাস্তবেই সকল মুমিনের জন্য সৌভাগ্যের রাত। গোনাহ থেকে মুক্তিলাভের রাত। হাদীসে এসেছে-
عن معاذ بن جبل، عن النبي صلى الله عليه وسلم قال: يطلع الله إلى خلقه في ليلة النصف من شعبان فيغفر لجميع خلقه إلا لمشرك أو مشاحن
অর্থাৎ, মুয়াজ ইবনে জাবাল রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে (চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) সৃষ্টির প্রতি (রহমতের) দৃষ্টি দেন। তখন মুশরিক ও বিদ্বেষপোষণকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন।” (সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং: ৫৬৬৫)
এ হাদীস থেকে বুঝা যাচ্ছে, এ রাতে আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়াতা’আলার পক্ষ থেকে সৃষ্টির প্রতি রহমত ও মাগফিরাতের দ্বার ব্যপকভাবে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। তার অফুরন্ত রহমতের বারিধারা বিশেষ শ্রেণীর কিছু লোক ছাড়া সকলের উপরেই বর্ষিত হয়। তাই তার রহমত ও মাগফিরাত প্রত্যাশি সকল ব্যক্তির জন্যই উচিত হল এ রাতটি ইবাদত-বন্দেগীতে কাটিয়ে সৌভাগ্যবানদের কাতারে নিজেকে শামিল করা। অবহেলা করে কিংবা গোনাহে লিপ্ত হয়ে এ রাতের মহত্ত্ব থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা কোনভাবেই কাম্য নয়।
এ হাদীস ছাড়াও অন্যান্য হাদীসে অর্ধ শা’বানের রাতে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ব্যাপক মাগফিরাতের ঘোষণা এসেছে। তাই এ রাত শবে বরাত তথা সৌভাগ্য বা মুক্তির রাত নামে প্রশিদ্ধি লাভ করেছে।
শবে বরাতে করণীয় আমল
আমরা পূর্বের আলোচনার মাধ্যমে এ কথা বুঝতে পেরেছি, রহমত ও মাগফিরাত প্রত্যাশি সকল মুমিনের জন্য এ রাত ইবাদত-বন্দেগীতে কাটিয়ে দেয়া উচিত। এক্ষেত্রে তো সবচায়ে উত্তম হল এমন আমল করা, যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিংবা সাহাবাগণ করেছেন। এমন কোন আমলের কথা জানা গেলে তা করাই সবচেয়ে ভাল হবে। তাই এ রাতে আমলযোগ্য একটি নির্ভরযোগ্য হাদীস পাঠকের সামনে তুলে ধরছি।
হযরত আলা ইবনুল হারিস রহ. থেকে বর্ণিত, হযরত আয়েশা রা. বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে নামাযে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সেজদা করেন যে, আমার ধারণা হল তিনি হয়ত মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামায শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়েশা অথবা বলেছেন, ও হুমাইরা, তোমার কি এই আশংকা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার এই আশংকা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কিনা। নবীজী জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তার রাসূলই ভাল জানেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তখন ইরশাদ করলেন, ‘এটা হল অর্ধ শাবানের রাত (শাবানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত)। আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে তার বান্দার প্রতি মনযোগ দেন এবং ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষপোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই।‘ (শুআবুল ঈমান, বাইহাকী: ৩/৩৮২-৩৬৮)
এ হাদীস থেকে বুঝা যায় এ রাতে দীর্ঘ নফল নামাজ পড়া। যাতে দীর্ঘ সেজদা করা হবে। পারলে দীর্ঘ ক্বেরার পড়বে। আমাদের দেশে কিছু ‘নামাজ শিক্ষা’ বই-এ নির্দিষ্ট কিছু নিয়মে নামাজ পড়ার কথা লেখা আছে। প্রথম রাকাতে অমুক সূরা এতবার, দ্বিতীয় রাকাতে এতবার ইত্যাদি। এ সকল নির্দিষ্ট নিয়মের কথা কোন হাদীসে পাওয়া যায় না। এগুলো মানুষের মনগড়া পদ্ধতি। আমরা স্বাভাবিকভাবে যেভাবে নফল নামায পড়ি, সেভাবেই দু’রাকাত করে যে কোন সূরা দিয়ে যত রাকাত সম্ভব নফল পড়ব। আর কারো কাজা নামায থাকলে তাও আদায় করে নিতে পারেন। মাঝে মাঝে ক্লান্তি দূর করার জন্য তাসবিহ পড়া যেতে পারে। এছাড়াও করণীয় হল, কুরআন কারীম তেলওয়াত, দরূদ শরীফ, ইস্তেগফার ও দুআ ইত্যাদি আমলের মাধ্যমে রাত অতিবাহিত করা। তবে একথা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে যে, এমন যেন না হয়, সারা রাতের দীর্ঘ ইবাদতের ক্লান্তিতে আমার ফজরের নামায জামাআতের সাথে পড়া সম্ভব হল না! তাই সারা রাত না পারলে নিজের সাধ্যানুযায়ী যতক্ষণ পারা যায় ইবাদত করতে হবে।
পরদিন রোজা রাখা
শা’বানের ১৫ তারিখে রোজা রাখার ব্যপারে হাদীসে এসেছে, হযরত আলী ইবনে আবু তালেব রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, পনের শাবানের রাত (চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত) যখন আসে তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদত-বন্দেগীতে কাটাও এবং দিনের বেলা রোযা রাখ। কেননা এ রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তাআলা প্রথম আসমানে আসেন এবং বলেন, কোন ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কোন রিযিকপ্রার্থী? আমি তাকে রিযিক দেব। এভাবে সুব্হে সাদিক পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা মানুষের প্রয়োজনের কথা বলে তাদের ডাকতে থাকেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৩৮৪)
এ হাদীস থেকে শা’বানের ১৫ তারিখ রাতে ইবাদতের মাধ্যমে কাটানো এবং পরদিন রোজার আমলের কথা জানা যায়। তাই অনেকেই এ দিনে রোজা রাখা মুস্তাহাব বলেছেন। শা’বান মাসে এমনিতেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেশী বেশী রোজা রাখতেন। ১ শা’বান থেকে ২৭ শা’বান পর্যন্ত রোযা রাখার যথেষ্ট ফযীলত রয়েছে এছাড়াও শাবানের ১৫ তারিখ আইয়ামে বীজ তথা আরবী মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখের অন্তর্ভুক্ত। আইয়ামে বীজে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোজা রাখতেন তা সহীহ হাদীসের মাধ্যমে স্বীকৃত। তাই মুসলমান ভাই-বোনদের প্রতি আমার আহবান হল, এ সকল হাদীসের বিবেচনায় পুরো শা’বান মাস জুড়েই (২৭ শা’বান পর্যন্ত) বেশী বেশী রোজা রাখা উচিত। তা না পারলে ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোজা রাখা। তাও সম্ভব না হলে অন্তত ১৫ তারিখের রোজা রাখা। আশা করি আল্লাহ তাআলা আমাদের শা’বান মাসের ফজিলত থেকে মাহরূম করবেন না।
শবে বরাতে যেসকল আমল কাম্য নয়
ইতিপূর্বে এ রাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমল সম্পৃক্ত একটি হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে নবীজী একাকী আমল করেছেন। তাই এ থেকে শিক্ষা নিয়ে বলতে হয়, এ রাতে দলবদ্ধভাবে মসজিদে একত্রিত হয়ে নফল ইবাদত না করে বাড়িতে একাকী করাই কাম্য। তা ছাড়া নফল ইবাদত বাড়িতে করাই উত্তম। সবার উপর বাড়িরও একটি হক থাকে। ইবাদতের মধ্যমে নিজ বাড়িকে আবাদ করা চাই। এ রাতে দলে দলে মসজিদে সমাবেত হয়ে ইবাদত করার বিষয়টিকে আমরা জরুরী মনে করি। অথচ এ বিষয় সম্পর্কে হাদীসেও পাওয়া যায় না। তাই আমরা নফল ইবাদতগুলো বাড়িতেই আদায় করব। এটাই সবচেয়ে ভাল।
তবে যদি কোন আহ্বান ও ঘোষণা ছাড়া এমনিই কিছু লোক মসজিদে এসে যায়, তাহলে প্রত্যেকে যার যার আমলে মশগুল থাকবে। এমন কোন কাজ করবে না, যাতে অন্যের আমলে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়।
কোন কোন জায়গায় এ রেওয়াজ আছে যে, এ রাতে মাগরিব বা ইশার পর থেকেই বাহিরের মাইক চালু করে ওয়াজ-নসীহত শুরু করা হয়। আবার কোথাও ওয়াজের পর মিলাদ-মাহফিলেরও আয়োজন করা হয়। সেখানে এমনভাবে মাইক চালানো হয়, যার দ্বারা মসজিদ বা মাহফিলের বাহিরের মানুষদের বাধ্য হয়ে ওয়াজ শুনতে হয়। এ ধরণের কাজ করা ঠিক না। কেননা শবে বরাতের ফজিলত ও আমল সম্পর্কে আলোচনা আগেই করে নেয়া যায়। অন্যথায় ইবাদতে আগ্রহী মানুষের পক্ষে ঘরে বসে একাগ্রতার সাথে ইবাদত করাও সম্ভব হয় না এবং মসজিদেও কুরআন তেলাওয়াত ইত্যাদি ইবাদত মন দিয়ে করা যায় না। তাই আমাদেও সকলের জন্য উচিৎ হল, এ রাতে যারা নিরবে বসে আমল করতে চায় তাদের জন্য সুযোগ করে দেয়া।
যেসকল কাজ বর্জনীয়
মসজিদ ও মহল্লায় আলোকসজ্জা করা, আতশবাজি ফুটানো, হালুয়া রুটি বানানো, সারারাত গল্প-গুজব, ঘুরা-ঘুরি ও হৈ-হুলোড় করে কাটিয়ে দেয়া। এ কাজগুলি সবই অপচয় ও বদ-রুসমের অন্তরভুক্ত। এতে না দুনিয়াবি ফায়দা আছে, না পারকালিন ফায়দা। এ রাতে রহমত ও মাগফিরাত প্রত্যাশি কোন মুনিনের জন্যই উচিত নয় ইবাদতে অবহেলা করে কাটিয়ে দেয়া। বদ-রুসম ও রেওয়াজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে হতভাগ্যদের কাতারে নিজেকে শামিল করা।
এছাড়াও এরাতে কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দলে দলে কবরস্থানে জমায়েত হবার যে রেওয়াজের প্রচলন আছে, তা শরিয়ত সম্মত না। এমনিতে নারীদের জন্য তো এর অনুমতি নেই। তাছাড়া পুরুষের জন্যও তো এমতাবস্থায় জিয়ারতের উদ্দেশ্যে জমায়েত হওয়া উচিত না। কেননা মুস্তাহাব পালন করতে গিয়ে কোন গোনাহে জড়িয়ে যাবার আশংকা থাকলে তা ছেড়ে দেয়াই উচিত। তাই এধরণের কাজ থেকে আমরা সবাই বিরত থাকব। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে হাফাজত করুন। আমীন।