চাই দরদ, ফিকির ও কাজের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য
মুফতী হাফীজুদ্দীন দা. বা.
(মাদরাসা কাসিমিয়্যাহ বলাশপুর ময়মনসিংহে বাদ ইশা নবীন উলামায়ে কেরামের মজলিশে মুফতী হাফীজুদ্দীন দা. বা. এর বয়ান ও নসিহতের অনুলিপি। প্রস্তুত করেছেন মাওলানা মাহদী আব্দুল হালিম)
উলামায়ে কেরাম নবীর ওয়ারিস। ওয়ারিস হিসাবে উলামায়ে কেরামের যিম্মাদারীও অনেক। আমাদের ফিকির করা উচিৎ যে, সামাজিক, ধর্মীয়, ইলমি-আমলি হালাতের প্রেক্ষাপটে আল্লাহ তাআলা যদি এই সময়ে একজন নবী পাঠাতেন, তাহলে নবী এ ক্ষেত্রে কী করতেন? নবীর যে কাজ হতো ওই কাজটিই এখন আমার। আল্লাহ তা’আলা ওই দায়িত্বটাই আমার কাঁধে সোপর্দ করেছেন। সে হিসেবে আমাকে খুঁজে বের করতে হবে, আমার করণীয় কী? নবীগণ তাদের উম্মতের কাছে দ্বীন পৌঁছানোর জন্য কী কী মেহনত করেছেন?
হযরত নূহ আলাইহিস সালাতু ওয়াসসালাম আল্লাহর কাছে বলেছেন,
.. رَبِّ إِنِّي دَعَوْتُ قَوْمِي لَيْلًا وَنَهَارًا
অর্থাৎ, “হে আমার রব! আমার সম্প্রদায়কে আমি দিনে দাওয়াত দিয়েছি, রাতে দাওয়াত দিয়েছি।” (অর্থাৎ হযরত নূহ আ. ইজতিমায়িভাবে, ইনফিরা.ভাবে সকল প্রকারে দাওয়াত দিয়েছেন।) ভেবে দেখুন, একজন নবী কতবড় সবরওয়ালা, কতবড় আযমওয়ালা। ঘাত-প্রতিঘাত, বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থা, কত ফিকির ও মেহনত-মুজাহাদার এক পর্যায়ে আল্লাহর কাছে বলছেন, ‘রাব্বি ইন্নি দাওয়াতু কওমী লায়লাও ওয়ানাহারা।’ সুতরাং একজন ওয়ারিসে নবীকেও এমন ফিকিরমান্দ হতে হবে। উম্মত নিয়ে, মানুষের ঈমান-আমল নিয়ে ভাবতে হবে। চেষ্টা-মেহনত করতে হবে।
আমি আত্মসমালোচনা করছি। কাউকে কটাক্ষ বা ছোট করার জন্যে নয়। কেননা আত্মসমালোচনা এমন জিনিস, যা ছাড়া কোন জাতির ইসলাহ হতে পারে না। নিজের ভুল নিয়ে কোন আলোচনা না হলে তার ভুলটা তো ভুলের জায়গায়ই থেকে যাবে। সংশোধন হবে না, ইসলাহ হবে না। আগে বাড়ার পথ বের হয়ে আসবে না।
আজকে আলেম হচ্ছে সংখ্যায় অনেক বেশি। মুহাদ্দিস, মুফাসসির, লেখক, ওয়ায়েজ, হার লাইনে একেকজন বাকামাল হচ্ছে। কিন্তু এর যোগ্যতা-সলাহিয়্যাত এর বিকাশ যেভাবে হওয়ার দরকার ছিলো সেইভাবে হচ্ছে না। এর বিপরীতে, আমাদের আকাবির ও আসলাফগণ আলাদা আলাদা শাস্ত্রে দক্ষ ছিলেন। কেউ সাহিত্যে, কেউ ফিক্হ ও ফতোয়ায়, কেউবা বয়ানে। কারো ছিল লিখনী শক্তির বলিষ্ঠতা। উদাহরণত হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ.। তিনি সাধারণতঃ উর্দূ শব্দে কথা বলতেন। জনসাধারণের মাঝে যখন বয়ান করতেন, তখনও। মাঝে মাঝে ব্যাকরণগত ভুল যদিও বলতেন, কিন্তু এর দ্বারা মানুষের অনেক ইসলাহ হয়েছে। অথচ আজ আমাদের বয়ানের মাঝে অনেক সৌন্দর্যতা এসেছে। ভাষার মাঝে এসেছে অনেক মাধুর্যতা, কিন্তু সমাজ পরিবর্তন হচ্ছে না। তার কারণ, আমাদের আকাবিরগণ ছিলেন মুখলিস। যা বলতেন, ইখলাসের সাথেই বলতেন। সংখ্যা বা টাকা-পয়সা তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল না। আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক জুড়ে দেয়াই ছিল মহান উদ্দেশ্য।
আমাদের আকাবিরগণ বলেছেন, শুরুতে দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে মাত্র দু’একজন ফারেগ হত। যেমন হযরত কাশ্মিরী রহ. এর সময়েও ফারেগীনদের সংখ্যা ছিল মাত্র পনের। অথচ কত খেদমত করে তাঁরা আমাদের আদর্শ হয়ে আছেন। কিন্তু এখনতো দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে হাজার হাজার ছাত্র ফারেগ হচ্ছেন। বাংলাদেশ থেকেও প্রতি বছর হাজার হাজার ছাত্র ফারেগ হচ্ছেন। কোথায় তারা? সমাজে তো তাদের উপস্থিতি নজরেই পড়ছে না। বুঝা গেল, আজ ইখলাসপূর্ণ আলেমদের বড়ই অভাব। ফিকিরমান্দ ও মুখলিস আলেম আজ তৈরী হচ্ছে না। এ সংকট আজ সর্বক্ষেত্রেই।
আজকে খ্রিস্টানদের লক্ষ্য আছে, টার্গেট আছে। কাদিয়ানিদের টার্গেট আছে। বাতিল ফিরকার টার্গেট আছে। টার্গেট করে করে তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের হেদায়েতের লাইনে কী টার্গেট আছে?
হযরত হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী রহ. একজন লেখক ছিলেন। এক হাত রেখেছেন উম্মতের নফসের উপর, আরেক হাতে রেখেছেন কলমে। উম্মতের ইসলাহের জন্য কতশত কিতাব তিনি লিখে গিয়েছেন। যে কিতাবসমূহ পড়ে মানুষের দিল পরিবর্তন হয়ে হয়েছে, হচ্ছে, হবেও ইনশাআল্লাহ। এখন সেই দরদ ও ফিকিরওয়ালা লেখক আমাদের মাঝে নেই। আল্লাহ তাআলা আমাদের মাঝে যেন উম্মতের ফিকির তৈরি করে দেন। আমীন।
সকলেই একটু ফিকির করি যে, এই উম্মতকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর জন্য আমি কী পদক্ষেপ নিতে পারি? আল্লাহ তাআলা যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি উম্মতকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর জন্য কী মেহনত করেছ? তখন আল্লাহ তাআলার কাছে আমি কী উত্তর দিব? আজ আমরা চেষ্টা যদিও করি, কিন্তু ক্ষমতার লোভে বা সম্পদের লোভে সত্য কথা বলি না। বড়ই দুর্বল আমাদের ঈমান। অথচ সাহাবায়ে কেরাম যখন ঈমান এনেছেন, তখন তাদের ঈমান ছিলো ‘বুনিয়ানুম মারছুছ’। শিশা ঢালা প্রাচীরের মত। কোন হুমকী, ধমকী বা কোন সমাজিক প্রভাবও তাদেরকে টলাতে পারেনি। সাহাবায়ে কেরাম প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা দ্বারাও প্রভাবিত হন নি। ভেবে দেখি, আজকে আমার কোন্ কাজটা এরকম আছে, যাকে আল্লাহ তা’আলার জন্য হচ্ছে বলা যায়! আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই হচ্ছে বলা যায়! তবে যা-ই করি, আল্লাহর রেজামন্দি হাসিলের জন্যই আমি করবো ইনশাআল্লাহ। এভাবে একেকজন যদি একেকটি দ্বীনি বিষয়কে লক্ষ্য বানিয়ে এগিয়ে যেতে পারি, ইনশাআল্লাহ সফলতা আসবেই। আমাদের মাঝে যদি লক্ষ্যে পৌঁছানোর দৃঢ়তা থাকে, তাহলে আল্লাহ তা’আলা অল্প সংখ্যকের দ্বারাও আমাদের হেদায়েতের ফায়সালা করতে পারেন। বড় বড় কারনামাও আল্লাহ তাআলা নিতে পারেন যদি আকাবিরগণের ন্যায় আমাদের মাঝেও দরদ ও ফিকির পয়দা হয়ে যায়।
শায়খুল ইসলাম হযরত হুসাইন আহমদ মাদানী রহ. বলেছেন, “আলেমের দিল হতে হবে দরিয়ার মত। সাগরের মত। সংকীর্ণ মনমানসিকতা থাকলে কাজ করা যাবে না। কারণ, একজন আলেম তো টার্গেট বানাবে সারা দুনিয়াকে।” আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।