নিজেকে বদলানোর সংকল্প; আত্মশুদ্ধি অর্জনের পূর্বশর্ত
মাওলানা সালাহুদ্দীন
দুনিয়ার বুকে নবী-রাসূল প্রেরণের অন্যতম উদ্দেশ্য হল উম্মতের ইসলাহ তথা আত্মশুদ্ধি। দুনিয়ার নানান সম্পর্কের ফেরে বান্দা যখন তার রবকে ভুলে যেতে বসে, নফস ও শায়তানের কুমন্ত্রনায় নানান ব্যাধি কলবে বাসা বাঁধতে শুরু করে। তখন প্রয়োজন হয় এর প্রতিষেধকের। চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার। মূলতঃ বান্দার কলবের এ পরিশুদ্ধকরণই নবী-রাসূল প্রেরণের অন্যতম উদ্দেশ্য।
কেননা, ইসলাহের প্রথম ধাপই হলো মনে মনে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হওয়া। মন-দিল তৈরী করা। দিল যদি আল্লাহকে পাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে যায়, তাহলে কোনো বাধাই বাধা নয়। মূলত নিজেকে বদলানোর সংকল্পই হচ্ছে আত্মশুদ্ধি অর্জনের পূর্বশর্ত। আল্লাহ তাআলা সবাইকে তাওফীক দান করুন। আমীন!
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “মানবদেহে একটি বিশেষ অঙ্গ আছে, তা ঠিক হলে গোটা দেহ ঠিক থাকে আর তা যখন নষ্ট হয়ে যায় তখন গোটা দেহ নষ্ট হয়ে যায়। তোমরা শুনে রাখ! তা হলো মানুষের কলব তথা হৃদয়।”
প্রশ্ন হল, কীভাবে আমি আমার কলবের পরিশুদ্ধতা অর্জন করতে পারি? এর ব্যাধির চিকিৎসাই বা কী? এর জবাব কুরআন ও হাদীসে যেসকল উপায়ের আলোচনা করা হয়েছে, তন্মধ্যে অন্যতম হল, সাদিকীন তথা আল্লাহওয়ালা-নেককার বুযুর্গদের সংশ্রবে থাকা। সর্বক্ষেত্রে শরীয়তের পাবন্দ হওয়া। সুন্নতের পূর্ণ অনুসারী হওয়া। গুনাহ বর্জন করা ইত্যাদি।
তবে এ ক্ষেত্রে সবার আগে প্রয়োজন হল নিজের ইসলাহের ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প করা। দিলে এ কথা বসানো যে, ‘আমি রোগাক্রান্ত (রূহানী রোগে)। আমার চিকিৎসা জরুরী।’ অতএব, দিল যদি তৈরী হয়, দুনিয়ার কোন সমস্যাই বান্দার অন্তরায় হতে পারে না। যখন আল্লাহর বান্দা আল্লাহকে পাওয়ার জন্য নিজের দিল তৈরী করে ফেলে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সেই বান্দার জন্য সকল বাধাকে দূর করে দেন। এ জন্য আল্লাহর কাছে দু‘আ করা চাই। মানার জন্য দিলের ভেতর যে যোগ্যতা লাগে, আল্লাহ তাআলা ঐ যোগ্যতা যেন আমাদেরকে দান করেন।
বান্দা যখন নিজের কলবের ইসলাহ চায়, দিল যখন অস্থির হয়ে যায়, তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে নুসরত-সাহায্য আসে,
وَالَّذِينَ جاهَدُوا فِينا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنا وَإِنَّ اللَّهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِينَ
অর্থাৎ, “যারা আমাকে পাওয়ার জন্য মেহনত-মুজাহাদা করে, (আমাকে পাওয়ার) পথসমূহ আমি তাদের জন্য খুলে দেই। নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা নেককারদের সাথে আছেন।” (সূরা আনকাবূত: ৬৯ ) এমনই একজন মুজাহিদ, হযরত মাওলানা শাহ ইসহাক মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ.। যিনি ছিলেন শাহ আব্দুল আজীজ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ. এর মেয়ের ঘরের নাতি এবং শাহ আব্দুল আজীজ রহ. এর যোগ্য উত্তরসুরী। হিজরী ত্রয়োদশ শতকে উপমহাদেশের অনেক বড় একজন মুহাদ্দিস। শাহ আব্দুল আজীজ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ. এর ইন্তেকালের পর হাদীস ও তাসাউফের লাইনে তিনিই তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত তথা উপমহাদেশে সকল মুহাদ্দিসের উস্তাদ ছিলেন তিনি।
শাহ ইসহাক দেহলভী রহ. এর হাদীসের দরসে এক ছাত্র ছিলো। প্রতি দিনই তাঁর দরসে যথাসময়ে উপস্থিত হয়ে যেতো। একদিন ছাত্রটি তাঁর দরসে উপস্থিত হওয়ার জন্য নির্ধারিত সময়ে কিতাব হাতে নিয়ে বাড়ী হতে বের হলো। পথিমধ্যে অতিক্রম করতে হতো এক জমিদারের বালাখানা। বালাখানায় অবস্থিত জমিদারের মেয়ের কুদৃষ্টি পড়ল এই ছাত্রের প্রতি। মেয়েটি ঐ ছেলেটিকে ধরে নিয়ে আসার জন্য লোক পাঠালো। জমিদারের মেয়ের নির্দেশে তারা ছেলেটিকে ধরে আনলো। ছেলেটি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী অপরাধ ভাই আমার? কেন আমাকে ধরে আনলে?” তারা বলল, “কোনো অপরাধ নেই। জমিদারের মেয়ে তোমাকে ধরে আনতে বলেছেন। তাই তোমাকে আনা হয়েছে।”
তারপর জমিদারের মেয়ে সে তালিবুল ইলমকে প্রাসাদে নিয়ে কুপ্রস্তাব দিল। একদিকে ছেলেটি ছিলেন শাহ ইসহাক দেহলভী রহ. এর ছাত্র। তাঁর সোহবত পেয়েছেন দীর্ঘ দিন। কথায় আছে, ‘বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলেই তার পরিচয়।’ সোহবতের বদৌলতে ছেলেটির দিল তৈরি হয়ে গিয়েছিল যে, আমার যিন্দেগীতে যত বাধা-বিপদই আসুক না কেন, আল্লাহ নারাজ হন এমন কোনো কাজ আমি করবো না।
একপর্যায়ে জমিদারের মেয়ে হুমকি দিল, “আমার সাথে যদি তুমি অপকর্মে লিপ্ত না হও, তাহলে জল্লাদ ডাকবো। সে তোমার গর্দান উড়িয়ে দিবে।” কিন্তু ছাত্রটি নির্বিকার। দৃঢ় সংকল্প করেছে, কোনো অবস্থাতেই আল্লাহর নাফরমানী সে করবে না। তাই ভাবছে, আমি যদি এই মেয়ের প্রস্তাবে সাড়া দেই, তাহলে আল্লাহ নারাজ হবেন। আমার আখেরাত নষ্ট হবে। আর যদি মেয়েটির ডাকে সাড়া না দেই, তাহলে আল্লাহ রাজি হবেন। কিন্তু আমার জীবন এখানেই শেষ হলেও আল্লাহর হুকুমই সবচেয়ে বড়! আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ বলেন,
وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجاً
অর্থাৎ, “যে আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার উত্তোরণের পথ বের করে দেন।” (সূরা তালাক:২)
মহান আল্লাহ তা’আলা কুদরতের দ্বারা সকল বাঁধাকে দূর করে দেন। তাই তালিবুল ইলম চিন্তা করছে, কী করবে? এদিকে আল্লাহ তাআলা আসমান থেকে তার জন্য ফায়সালা নাযিল করলেন। তাঁর দিলের মধ্যে মুক্তির উপায় ঢেলে দিলেন। এখান থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার পথ তাকে শিখিয়ে দিলেন।
সে বলল, “হে জমিদারের মেয়ে! তোমার ডাকে আমি সাড়া দিব, তবে বাথরুমে যাওয়ার অনুমতি দিতে হবে আমায়।” মেয়েটি বলল, “ঠিক আছে যাও।” ছেলেটি বাথরুমে গিয়ে নিজের মল নিজেই পুরো শরীরে মাখাল। আল্লাহর ভয়ে গুনাহ থেকে বাঁচার জন্য ‘তালিবে ইলম’ এ কী উপায় অবলম্বন করলেন। সুবহানাল্লাহ! আল্লাহ যেন নারাজ না হন, সে জন্য কত কুরবানী! এরপর সে বের হয়ে এল। জমিদারের মেয়ে তাকে দেখে ছিঃ ছিঃ করে উঠল। বলল, “ছেলেটি তো পাগল। এই! কে আছো? তাড়াতাড়ি একে বের করে দাও। মুহূর্তের মধ্যে বালাখানার সব দরজা খুলে দেয়া হলো। ঈমান-আমল ও আল্লাহর সন্তুষ্টি নিয়ে সে আল্লাহর ওলী হয়ে ফিরে এল।
এবার সে রওয়ানা হল হাদীস পড়ার জন্য। ভাবছে, নাপাক শরীর নিয়ে যাব কিভাবে? এক জায়গায় সামান্য পানি পেয়ে যতটুকু সম্ভব সারা শরীর ধুয়ে নিল। তারপর শাহ ইসহাক দেহলভী রহ. এর দরসে উপস্থিত হল। তালিবুল ইলম দরজার সামনে এসে দাঁড়ালে শাহ ইসহাক দেহলভী রহ. তাকে ভেতরে আসতে বারণ করলেন। ছেলেটি তাই বাহিরেই দাঁড়িয়ে রইলো। শাহ ইসহাক মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ. হঠাৎ মুগ্ধ হয়ে বললেন, “এই বাবা! কী আতর লাগিয়ে এসেছ?” সে বলল, “হুজুর মাফ করে দেন।” হুজুর যতই জিজ্ঞাসা করেন, কি আতর লাগিয়েছ? ছেলেটি বলে, হুজুর! মাফ করে দেন। এক পর্যায়ে শাহ ইসহাক দেহলভী রহ. ছাত্রদের উদ্দেশ্য করে বললেন, “তোমরা সবাই চলে যাও! আর পড়াবো না।” সব ছাত্র বের হয়ে যাওয়ার পর হুজুর ছাত্রটিকে বললেন, “এদিকে এসো, আমার কাছে এসো। কী হয়েছে? খুলে বলো!” তালিবুল ইলম এর কাছে ঘটনার বিবরণ শুনে হযরত শাহ ইসহাক দেহলভী রহ. এর চোখ দিয়ে পানি এসে গেল। দরদভরা কণ্ঠে বললেন, “এত বছর ধরে হাদীস পড়াচ্ছি। হাদীসে জান্নাতের খুসবু তথা মেশকে আম্বরের বিবরণ পড়েছি। কিন্তু তার সুঘ্রান অনুভব করতে পারিনি। বাবা! তোমার শরীর থেকে তো জান্নাতের মেশকে আম্বরের সুঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে।” সুবহানাল্লাহ! আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে এ থেকে শিক্ষা নেয়ার তাওফীক দান করুন। আমিন।