বস্তুবাদ নয়; আল্লাহর প্রতি ভরসাই হোক বান্দার পাথেয়
মুহাম্মদ উল্লাহ ইয়াহ্ইয়া
বৈষয়িক জীবনে বস্তুর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। জীবনধারণে মানুষকে জীবনোপকরণ সংগ্রহ করতে হয় সর্বক্ষেত্রেই। ক্ষেত-খামার, চাকরী-বাকরী, ব্যবসা-বানিজ্য এ-সবই জীবনের বাস্তবতা। হালাল রিযিক সন্ধান করা দ্বীনে ইসলামেও আবশ্যকীয় এক বিষয়। তবে এ ক্ষেত্রে দ্বীনে ইসলাম মানবজাতিকে গুরুত্বপূর্ণ এক বার্তা প্রদান করে। জীবনোপকরণ সংগ্রহের দৃষ্টিভঙ্গিটা বদলে দেয়। বস্তু থেকে মানুষের বিশ্বাসকে সরিয়ে নিয়ে যায় বস্তুর ¯্রষ্টা মহান আল্লাহ তাআলার দিকে। সধঃবৎরধষরংস তথা বস্তুতান্ত্রিক মনোভাব ও অন্ধ বস্তুবাদী চিন্তা-চেতনার ভ্রান্তি সম্পর্কে তাদের সজাগ করে। ইসলাম এ কথা শেখায় যে, আল্লাহ তাআলাই সবকিছু করেন। বস্তুর নিজের কিছু করার ক্ষমতা নেই। আল্লাহ তাআলাই সবকিছুর ¯্রষ্টা। মহান আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল আর ভরসার পাশাপাশি সাধ্যমত চেষ্টা করা বান্দার সফলতার পূর্বশর্ত। যা দুনিয়া ও আখেরাতে তার জন্য সৌভাগ্য ও সফলতার দ্বারকে উন্মোচিত করবে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانْتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِنْ فَضْلِ اللَّهِ وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
অর্থাৎ, নামায সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ করতে থাকো। অধিক পরিমানে আল্লাহর স্মরণ করো, যেন তোমরা সফল হতে পারো। (সূরা জুমু‘আ: ১০)
শয়তানী এক প্রবঞ্চনা
বনু আদম সৃষ্টির উদ্দেশ্য হল তারা আল্লাহ তাআলার ইবাদত করবে। দুনিয়া নয় বরং আখেরাতে সফল হওয়ার জন্য মুজাহাদা করবে। আর এ অবস্থান মানুষের জন্য সম্মানের কারণ। সৃষ্টির সেরা হওয়ার রহস্য নিহিত আছে এখানেই। কিন্তু শয়তান মানুষের চিরশত্রু। সে তাদরেকে বিভ্রান্ত করে। মানুষ দুনিয়ার চিয ও আসবাবের মোহে মত্ত হয়ে যায়। একপর্যায়ে সে আসবাব ও বস্তুকেই সবকিছুর নিয়ন্তা ভাবতে শুরু করে। সধঃবৎরধষরংস তথা বস্তুবাদী মানসিকতার এ প্রবণতাটি পূর্বেও ছিল আজো আছে। তবে ব্যবধান হল একবিংশ শতাব্দীতে এসে প্রযুক্তি ও আই.টি সেক্টরে বিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নতি অনেককে ধাধায় ফেলে দিয়েছে।
মানুষ বিজ্ঞানের নানান আবিষ্কার দেখে, বস্তুর বাহ্যিক কার্যকরিতা দেখে বস্তুকেই শক্তির উৎস ভাবতে শুরু করে। রোগ হলে নিরাময়কারী হিসাবে ডাক্তার এবং ঔষধের প্রতি তার বিশ্বাস গড়ে ওঠে। চাকরী ও ব্যবসাকে সে রিযিকদাতা মনে করতে থাকে। এভাবে ক্রমে আল্লাহ তাআলার প্রতি বান্দার ঈমান দুর্বল হতে থাকে। তারা এ কথা ভুলে যায় যে, এ বস্তুর ¯্রষ্টা কে? বস্তুর মাঝে এ ক্ষমতা কে দিয়েছেন? এক পর্যায়ে কারো ক্ষেত্রে তা ঈমান হারা হওয়ার শংকা তৈরী করে। নাউযুবিল্লাহ।
এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়ে আল্লাহ তাআলা তাঁর কালামে পাকে ইরশাদ করেন,
وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ
অর্থ : পার্থিব এ জীবন তো প্রতারণার বস্তু ছাড়া কিছুই নয়। ( সূরা হাদীদ-২০)
যুগের অন্যতম ফিতনা
অন্ধ বস্তুচর্চা ও বস্তুর প্রতি মানুষের ভরসা এ যুগে বড় এক ফিতনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সাথে সাথে এ প্রবণতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ প্রবণতা দুনিয়াতে মানব প্রেরণের লক্ষ্য সম্পর্কে মানুষকে উদাসিন করে তোলে। নিজের রবের সন্তুষ্টি অর্জন তার কাছে তখন গৌণ হয়ে যায়। দুনিয়ার আসবাব উপকরণ সংগ্রহেই তার জীবনের মূল্যবান সময়গুলো ব্যয় হতে থাকে। খালেককে ভুলে মাখলুক পর্যন্তই তার সকল মেহনত সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। বিত্ত-বৈভব আর সুনাম-সুখ্যাতির মোহ তাকে লক্ষ্যহীন জীবনে আছড়ে ফেলে। সে তখন বিভ্রান্তির তরঙ্গবিক্ষুব্ধ অতল সমুদ্রে হাবুডুবু খায়। তীরের সন্ধান আর সে পায় না। আল্লাহ তাআলা তাঁর পবিত্র কলামে ইরশাদ করেন,
إِنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ
অর্থাৎ “তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি ফিতনা স্বরূপ।” (সূরা তাগাবুন: ১৫)
বস্তুর ¯্রষ্টাকে ভুলে খুদ বস্তুর প্রতি এ ঝোক মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন উভয়বিদ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সে তখন দুনিয়ার আসবাব অর্জনে পেরেশান হয়ে যায়। একেই প্রকৃত সফলতা ভেবে অস্থায়ী জীবনের জন্য নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দেয়।
বস্তুতান্ত্রিকতা ও কাফের সম্প্রদায়
ইসলামের দৃষ্টিতে পার্থিব জীবন পরকালের ফসলক্ষেত্র স্বরূপ। এ দুনিয়ায় বসবাস করেও মানুষের দৃষ্টি থাকতে হবে আখেরাতের জিন্দেগীর প্রতি। এ জগতে ঈমান ও আমলের বিনিময়ে আখেরাতে আল্লাহ তাআলা মানুষকে প্রতিদান দিবেন। সুতরাং এ দুনিয়ার আসবাব উকরণকেই জীবনের মূল সাব্যস্ত করে এর পিছে সকল চেষ্টা-মেহনত ব্যয় করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
“প্রকৃত জ্ঞানী সে ব্যক্তি যে নিজের রিপুকে নিয়ন্ত্রন করে; এর হিসাব নেয় এবং মৃত্য পরবর্তী যিন্দেগীর জন্য আমল করে।”
অন্যদিকে বস্তুবাদের মূল শিকারে পরিণত হয়ে আছে কাফের সম্প্রদায়। দুনিয়ার আসবাব উপকরণের পিছেই নিজেদের জীবনকে তারা নিঃশেষ করে দেয়। বস্তুর প্রতি তাদের বিশ্বাস ¯্রষ্টার প্রতি বিশ্বাসের চেয়েও হয় প্রবল। দুনিয়ার ভোগ-বিলাসই হয় তাদের জীবনের সার। বস্তুতান্ত্রিকতার মোহে পড়ে আখেরাতকে তারা অস্বীকার করে। তারা বলে পার্থিব জীবনই তো একমাত্র জীবন। এরপর আর কোন জীবন নেই। মহান আল্লাহর সামনে হাজির হতে হবে, দুনিয়ার জীবনে হিসাব দিতে হবে, এ বাস্তবতা তাদের কাছে অমূলক মনে হয়।
এ বাপ্যারে কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে-
إِنَّ اللَّهَ يُدْخِلُ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ وَالَّذِينَ كَفَرُوا يَتَمَتَّعُونَ وَيَأْكُلُونَ كَمَا تَأْكُلُ الْأَنْعَامُ وَالنَّارُ مَثْوًى لَهُمْ
অর্থাৎ, “যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার নি¤œদেশ দিয়ে নহরসমূহ প্রবাহিত। আর যারা কুফুরী করে তারা ভোগ-বিলাসে মত্ত থাকে এবং জন্তু-জানোয়ারের মত উদর পূর্তি করে; জাহান্নামই তাদের নিবাস। (সূরা মুহাম্মদ: ১২)
কৃতকর্মের ফল হিসাবে কাফেরদেরকে আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার ভোগ-সামগ্রী প্রদান করেন। আখেরাতে তারা আর কিছুই পাবে না।
মহান আল্লাহ তাআলা আরো ইরশাদ করেন,
{ وَلَوْلَا أَنْ يَكُونَ النَّاسُ أُمَّةً وَاحِدَةً لَجَعَلْنَا لِمَنْ يَكْفُرُ بِالرَّحْمَنِ لِبُيُوتِهِمْ سُقُفًا مِنْ فِضَّةٍ وَمَعَارِجَ عَلَيْهَا يَظْهَرُونَ . وَلِبُيُوتِهِمْ أَبْوَابًا وَسُرُرًا عَلَيْهَا يَتَّكِئُونَ. وَزُخْرُفًا وَإِنْ كُلُّ ذَلِكَ لَمَّا مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةُ عِنْدَ رَبِّكَ لِلْمُتَّقِينَ}
“সত্য প্রত্যাখ্যানে মানুষ এক মতালম্বী হয়ে যাবে এমন আশংকা না থাকলে দয়াময় আল্লাহকে যারা অস্বীকার করে তাদেরকে আমি তাদের গৃহের জন্য রৌপ্য নির্মিত ছাদ ও সিঁড়ি দিতাম যাতে তারা আরোহন করে। তাদের গৃহের জন্য আরো দিতাম দরজা ও পালঙ্ক যাতে হেলান দিয়ে তারা বিশ্রাম করতে পারে এবং স্বর্ণ নির্মিতও। এসবই পার্থিব জীবনের ভোগ মাত্র। আর মুত্তাক্বীদের জন্য আখেরাতে রয়েছে বিরাট কল্যাণ।” (সূরা যুখরূফ: ৩৩-৩৬)
দুনিয়ার আসবাব ও মু‘মিন সম্প্রদায়
দুনিয়ার আসবাব ও বস্তু সম্পর্কে মুমিনদের কী মনোভাব হওয়া উচিৎ তা নি¤েœর আয়াতে পরিষ্কার করে দেয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-
رِجَالٌ لَا تُلْهِيهِمْ تِجَارَةٌ وَلَا بَيْعٌ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ وَإِقَامِ الصَّلَاةِ وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ يَخَافُونَ يَوْمًا تَتَقَلَّبُ فِيهِ الْقُلُوبُ وَالْأَبْصَارُ
“সে সব লোকদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্বরণ থেকে এবং নামাজ কায়েম করা ও যাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখে না। তারা ভয় করে সে দিনকে যে দিন অনেক অন্তর ও দৃষ্টি বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।” (সূরা নূর: ৩৭)
একবার মদীনায় খাদ্যশস্যের সংকট দেখা দিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুমুআর খুতবা দিচ্ছিলেন, এরই মধ্যে খাদ্যশস্য আমদানীকারক একটি ব্যবসায়ী কাফেলা সেখানে আগমন করল। দ্রুত খাদ্যশস্য সংগ্রহের জন্য কেউ কেউ খুতবা চলা অবস্থাতেই মসজিদ থেকে বের হয়ে গেলেন। তখনো জুমুআর খুতবা শোনার আবশ্যকতা সম্পর্কিত বিধান সকলের জনাও ছিল না। আল্লাহ তাআলা তখন আয়াত নাযিল করলেন,
وَإِذَا رَأَوْا تِجَارَةً أَوْ لَهْوًا انْفَضُّوا إِلَيْهَا وَتَرَكُوكَ قَائِمًا قُلْ مَا عِنْدَ اللَّهِ خَيْرٌ مِنَ اللَّهْوِ وَمِنَ التِّجَارَةِ وَاللَّهُ خَيْرُ الرَّازِقِينَ
অর্থাৎ, “তারা যখন ব্যবসা ও কৌতুক দেখে, আপনাকে তারা দাঁড়ানো অবস্থায় রেখেই সেদিকে ছুটে যায়। আপনি বলুন, আল্লাহর নিকট যা আছে তা ক্রীড়া-কৌতুক ও ব্যবসা অপেক্ষা উত্তম। আল্লাহ তাআলাই সর্বশ্রেষ্ঠ রিযিকদাতা। (সূরা জুমু‘আ: ১১)
আল্লাহর প্রতি ভরসাতেই বান্দার সফলতা নিহিত
মূলত আল্লাহর প্রতি ভরসাতেই বান্দার সফলতা নিহিত। কেননা বস্তুর নিজস্ব কোন ক্ষমতা নেই। আল্লাহ তাআলা বান্দার জন্য যতটুকু তাকদীরে ফায়সালা করে রাখেন ততটুকুই সে পায়। তাকদীরকে লঙ্ঘন করার সাধ্য কারো নেই। হযরত যায়েদ ইবনে সাবেত রা. এবং হযরত উবাই ইবনে কাআব রা. এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
ما أصابك لم يكن ليخطئك وأن ما أخطأك لم يكن ليصيبك
অর্থাৎ, তুমি যা পেয়েছো বা তোমার ক্ষেত্রে যা ঘটেছে তা তাকদীরের ফায়সালা মতেই ঘটেছে, তা তোমার ক্ষেত্রে না ঘটার ছিল না। আর যা তুমি পাওনি বা যা তোমার ক্ষেত্রে ঘটেনি তা তাকদীরী ফায়সালা মতেই তোমার ক্ষেত্রে ঘটার ছিল না। (সুনানে আবু দাউদ: ৪৭০১)
অতএব, মহান আল্লাহ তা’আলার উপর পূর্ণ ভরসা রেখে, তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলে জীবন পরিচালনা করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। কেননা, আমার সফলতার পাথেয় তো একমাত্র আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও ভরসা এবং তাঁরই অনুগ্রহ।