আমিরুল হিন্দ হযরত মাওলানা মারগুবুর রহমান রহ.
আমিরুল হিন্দ হযরত মাওলানা মারগুবুর রহমান রহ.
মুহতামিম, দারুল উলূম দেওবন্দ, ভারত
মুফতী হাফীজুদ্দীন
জন্ম : ১৩৩৪ হিজরি মোতাবেক ১৯১৪ ঈসায়ী।
মৃত্যু: ১ মুর্হরম ১৪৩২ হিজরী মোতাবেক ৮ ডিসেম্বর ২০১০ ঈসায়ী।
ফারাগাত : ১৩৫২ হিজরি মোতাবেক ১৯৩২ ঈসায়ী, দারুল উলূম দেওবন্দ।
মুহতামিমের মেয়াদ : ১৯৮২ ঈ. থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রায় ৩০ বছর।
জীবন কাল : হিজরী সন হিসাবে ৯৮ বছর।
ঈসায়ী সন হিসাবে ৯৬ বছর।
সমাধী : মাকবারায়ে কাসেমী, দারুল উলূম দেওবন্দ, ইউ.পি., ভারত।
হযরত মাওলানা মারগুবুর রহমান রহ. বহু গুণের অধিকারী একজন ফেরেশতাতুল্য মানুষ ছিলেন। বংশ ধারাবাহিকতায় তাঁর বংশ হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদি. পর্যন্ত পৌঁছে। তাই বংশীয়ভাবে তিনি সিদ্দীকী। উত্তর প্রদেশ বিজনূরের নওয়াজ শহরে এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে তাঁর জন্ম। ১৩৩৪ হিজরি মোতাবেক ১৯১৪ ঈ. এই মহান ব্যক্তিত্ব দুনিয়াতে পদার্পন করেন। বিজনূরের মাদরাসায়ে রহিমিয়া থেকে থেকে তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। শরহে বেকায়া জামাত পর্যন্ত এখানে পড়েন অতপর ইলমে অহির মারকায ঐতিহ্যবাহী দারুল উলূম দেওবন্দে ১৩৪৭ হিজরি মোতাবেক ১৯২৯ ঈ. সনে ভর্তি হন।
তাঁর উস্তাদবৃন্দের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন: ১. শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা সায়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদানী রহ. ২. শায়খুল আদব হযরত মাওলানা এজায আলি রহ. ৩. হযরত মাওলানা মুফতি শফি রহ. (মুফতীয়ে আজম পাকিস্তান ) ৪. হযরত মাওলানা সায়্যিদ আসগর হুসাইন রহ. ৫. হযরত মাওলানা কারী মুহাম্মদ তৈয়্যব রহ. ৬. হযরত মাওলানা আল্লামা ইবরাহীম বলয়াভী রহ,, ৭. হযরত মাওলানা গোলাম রাসূল খান রহ., ৮. হযরত মাওলানা নবী হাসান রহ.।
দাওরায়ে হাদিস থেকে ফারাগাত হাসিলের পর প্রায় তিন বছর অসুস্থ থাকার কারণে পড়ালেখার ধারাবাহিকতা বন্ধ থাকে। সুস্থ হওয়ার পর আবার দারুল উলূম দেওবন্দে চলে আসেন। হযরত মাওলানা মুফতি মুহাম্মাদ সহুল ভাগলপুরি রহ. সহ অন্যান্য মুফতি হযরতদের কাছে ইফতা (মুফতি ) কোর্স সমাপ্ত করেন।
তাঁর বাবা হযরত মাওলানা মাশিয়াতুল্লাহ রহ.। তিনি ছিলেন হযরত শায়খুল হিন্দ রহ.-এর বিশিষ্ট শাগরেদ। আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী রহ.-এর সাথে তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। যখনই হযরত কাশ্মিরী রহ. বিজনৌর যেতেন মাওলানা মাশিয়াতুল্লাহ রহ.-এর বাড়িতে উঠতেন। তিনি দারুল উলূম দেওবন্দের মজলিসে শুরার সদস্য ছিলেন।
ফারাগাতের পর নিজ এলাকায় মানুষের ঈমান-আমল সংশোধন ও মুসলমান বাচ্চাদের দ্বীনি শিক্ষার ব্যাপারে অত্যন্ত ফিকিরমান্দ হলেন। সামাজিক ও পারিবারিক বিভিন্ন ব্যস্ততার মাঝেও বাড়ির পাশের মসজিদে দীর্ঘ ২৫ বছর ইমামতির দায়িত্ব আঞ্জাম দেন। এই সময় তিনি মসজিদ থেকে বেতন-ভাতা নেওয়া তো দূরের কথা বরং মসজিদের যাবতীয় জরুরত পূরণে নিজে খরচ বহন করতেন। মসজিদ পরিচালনার সম্পূর্ণ দায়িত্ব তাঁর উপরই ছিল।
তাঁর বংশের পূর্বসূরিরা দারুল উলূম দেওবন্দের সাথে সম্পর্কিত ছিলেন। দারুল উলূমের উন্নয়নে তাঁদের সহযোগিতা ছিলো অত্যন্ত প্রশংসামূলক। সে ধারাবাহিকতায় মাওলানা মারগুবুর রহমান রহ. নিজ বংশীয় ঐতিহ্যকে ধরে রেখে সঠিক রাহনুমায়ি ও নিজ বিচক্ষণতা দ্বারা দারুল উলূম দেওবন্দের সহযোগিতায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে মজলিসে শূরা তাঁকে ১৩৮২ হিজরি মোতাবেক ১৯৬২ ঈসায়িতে দারুল উলূমের শূরা পদে নিয়োগ দেন। এই পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর শূরার প্রত্যেক মিটিং এ হাজির থাকা, সঠিক রায় পেশ করা, কল্যাণময় পদক্ষেপে অবিচল থাকা (এবং ইলমি প্রাজ্ঞতাও) নিজের জন্য আবশ্যক করে নিয়েছিলেন।
শুরার মিটিং এ বিজনৌর থেকে দেওবন্দ আসা-যাওয়ার খরচ কখনো মাদরাসার ফান্ড থেকে গ্রহণ করেননি। এমনকি চা-নাস্তা খেলেও তার খরচ মাদরাসার ফান্ডে জমা করে দিতেন।
তাঁর ইলমি প্রাজ্ঞতা, পরিচালনার দক্ষতার (এন্তেÍযামি সালাহিয়্যাত) উপর শূরার সদস্যদের পরিপূর্ণ আস্থা ছিল। এই কারণেই দারুল উলূম দেওবন্দের ‘সদ সালার’ পর হাকীমুল ইসলাম হযরত মাওলানা ক্বারি মুহাম্মাদ তায়্যিব রহ. এর দরখাস্তের ভিত্তিতে মজলিসে শূরা তাঁকে ১৪০১ হিজরি মোতাবেক ১৯৮১ ঈ. সনে মুঈনে মোহতামিম পদে নিয়োগ দেন।
অতপর ১৯৮১ ঈসায়িতে দারুল উলূমে অনাকাঙ্ক্ষিত বিশাল ঘটনা সংগঠিত হয়। একপর্যায়ে দারুল উলূম দেওবন্দ দুই ভাগ হয়ে যায়। সে সময় মজলিসে শূরা হযরত মাওলানা মারগুবুর রহমান সাহেবকে মোহতামিমের পদে ১৪০২ হিজরি মোতাবেক ১৯৮২ ঈসায়িতে সর্বসম্মতিক্রমে নিয়োগ দেয়।
দীর্ঘ ৩০ বছর মুহতামিমের দায়িত্ব পালনকালে তিনি মাদরাসা থেকে কোনো বেতন-ভাতা গ্রহণ করেননি। মাদরাসার পক্ষ থেকে দেয়া ছোট্ট রুম, যাতে তিনি অবস্থান করতেন সেটির ভাড়া মাদরাসার ফান্ডে জমা করে দিতেন। মেহমানদের চা-নাস্তার খরচ নিজে বহন করতেন। এমনকি অফিস চলাকালীন সময়ে কোনো মেহমান আসলে তার আপ্যায়ন খরচও নিজে বহন করতেন। নিজের পৈতৃক সম্পত্তির অংশ বিশেষ বিক্রি করে মাদরাসার বিভিন্ন খরচ বহন করেছেন।
মাদরাসার গুরুত্বপূর্ণ কাজ পরামর্শের ভিত্তিতে আঞ্জাম দিয়েছেন। নিজস্ব রায়কে অযৌক্তিকভাবে চাপিয়ে দেওয়ার মনমানসিকতা তাঁর ছিল না। পরামর্শের পর যে সিদ্ধান্ত হতো তার কার্যকর করার ক্ষেত্রে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। মাদরাসার আয়-ব্যয়ের হিসাব সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের থেকে পুরোপুরি বুঝে নিতেন। দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের থেকে পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব নিতেন।
তিনি ছিলেন প্রশাসনিক দক্ষতাসম্পন্ন, সুশৃৃঙ্খল কাজের মূর্তপ্রতীক। দারুল উলূমের সকল বিভাগের প্রতি গভীর নজর রাখা, আমানাতদারি, সরলতা, বিনয়, ন¤্রতা, ছাত্রদের আরাম ও জরুরত পূরণের ফিকির, শিক্ষকবৃন্দ ও স্টাফদের পরস্পর সুসর্ম্পক, সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ, যোগ্য ব্যক্তিদের মূল্যায়ন তাঁর অভ্যাসের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছিল। বার্ধক্যজনিত দূর্বলতা এবং বিভিন্ন রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত থাকা সত্ত্বেও মাদরাসার দায়িত্বে কোন ত্রুটি আসতে দেননি। ছাত্রদের প্রতি দরদমান্দ, দারুল উলূমের কল্যাণে জীবন উৎসর্গকারী আকাবিরের খাঁটি উত্তরসূরি ছিলেন তিনি।
মরহুম অত্যন্ত সঙ্কটময় মুহূর্তে দারুল উলূমের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তাঁকে ওই সময় থেকে বহু প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়েছে। কিন্তু ইখলাস ও তাআল্লুক মাআল্লাহর কারণে তাঁকে বড় কোনো বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি।
তাঁর নেতৃত্বে দারুল উলূম দেওবন্দের বহুমুখী উন্নতি হয়েছে। শিক্ষা ও নির্মাণ উভয় ক্ষেত্রে সংস্কারমূলক কর্মকান্ড হয়েছে। নতুন নতুন বিভাগ খোলা হয়েছে এবং শিক্ষা বিভাগীয় কার্যক্রমে বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন ও ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন করা হয়েছে। ছাত্র-শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধার পরিসর বৃদ্ধি করা হয়েছে। নতুন ভবন যেমন নির্মিত হয়েছে তেমনি অনেক পুরনো ভবনের সংস্কারও হয়েছে তার হাত ধরে। বলতে গেলে তাঁর যুগ ছিল দারুল উলূম দেওবন্দের ইতিহাসের একটি সোনালী অধ্যায়।
তিনি ভারত উপমহাদেশের অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী রহ.-এর নিকট আধ্যাত্মিক সবক নিয়েছিলেন। ব্যক্তিজীবনে ছিলেন সহজ-সরল ও সাদাসিধে চরিত্রের অধিকারী। বিশ্বখ্যাত ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন অনাড়ম্বর জীবন-যাপনে অভ্যস্থ। আকাবিরের পদাঙ্ক অনুসরণের ব্যাপারে পুরোপুরি যত্নবান ছিলেন। ভারতের রাজনৈতিক পরিম-লেও তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ছিল। তিনি ভারতের জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। দারুল উলূমের প্রশাসনিক কার্যক্রমে ব্যস্থতার মধ্যেও ইসলাহী ও জন কল্যাণমূলক সভা-সেমিনারে যোগদান করতেন। যে কোনো সঙ্কটকালে তিনি দারুল উলূম ও ভারতের মুসলমানদের পক্ষে সম্মানজনক ভূমিকা রাখতে সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন।
আমি নালায়েক ১৪২০ হিজরী মোতাবিক ১৯৯৯ ঈ. দারুল উলূম দেওবন্দ দাওরা পড়াবস্থায় হযরত মাওলানা মারগুবুর রহমান রহ. কে বারবার দেখার সুযোগ হয়েছে। হযরত রহ.-এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল চুপ থাকা। আসরের পর নিজ কামরা থেকে বের হয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে মসজিদে রশীদের বারান্দায় এসে বসতেন। কারো সাথে কোনো কথা বলতেন না। মাগরিবের নামায আদায় করে আবার নিজ কামরায় ফিরে যেতেন। আমার পড়াকালীন সময়ে অনেক ঘটনা দেখেছি, শুনেছি।
একবার কয়েকজন ছাত্র বোর্ডিং এর খানার ব্যাপারে হযরত রহ.-এর কাছে শেকায়েত করলে হযরত রহ. তাৎক্ষণিকভাবে নিজে হযরত মাওলানা কারী ওসমান দা. বা. সহ আরো কয়েকজন শিক্ষক নিয়ে বোর্ডিং এ উপস্থিত হলেন। বাবুর্চি ও বোর্ডিং পরিচালককে নিজ দায়িত্বের ব্যাপারে জোর সচেতন করলেন। ভবিষ্যতে ছাত্রদের সাথে অমূলক কোনো আচরণ যেন না করা হয় সে ব্যাপারে নির্দেশ দিলেন। এভাবে মাদরাসার যেকোনো সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধানে সচেষ্ট হতেন।
আরেকবার ছাত্রদের সাথে এলাকার কিতাব বিক্রেতা দোকানদারদের সাথে কোনো বিষয়ে দূরত্ব ও অনাকাক্সিক্ষত কিছু ঘটনা ঘটে যায়। যার কারণে দোকানদানদের আর্থিক কিছু ক্ষতিও হয়ে যায়। হযরত রহ. ঘটনাটি শুনে সকল দোকানদারকে ডেকে সান্ত¦না দেন এবং নিজ পকেট থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করে দেন।
মাদানী পরিবারের সাথে তাঁর ইলমী, রূহানী ও পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। মুহতামিম সাহেবের ছেলে হযরত মাওলানা আনোয়ারুর রহমানের সাথে হযরত ফিদায়ে মিল্লাত রহ.-এর বড় মেয়ের বিবাহ হয়। তাদের দাম্পত্যজীবনে তিন মেয়ে ও দুই ছেলে জন্ম লাভ করে। মাওলানা আনোয়ারুর রহমান বর্তমানে দ্বীনি বিভিন্ন খেদমত আঞ্জাম দেওয়ার পাশাপাশি শূরার সদস্য হিসাবে দারুল উলূম দেওবন্দের খেদমত করে যাচ্ছেন।
হযরত মুহতামিম সাহেব রহ. বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দ্বীনি সফর করেছেন বহুবার। সে সূত্রমতে বাংলাদেশেও তাঁর সুভাগমন হয়েছিল। বাংলাদেশের যে সমস্ত ফুযালা দারুল উলূম দেওবন্দের ঐতিহাসিক সদ সালায় উপস্থিত হতে পারেননি, তাদের দস্তারে ফযিলতের সুবিশাল সম্মেলন ঢাকা মালিবাগ চৌধুরীপাড়াস্থ ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়। তখন দারুল উলূম দেওবন্দের পক্ষ থেকে তিন মহামনীষী এ অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। তারা হলেন ফিদায়ে মিল্লাত হযরত মাওলানা সায়্যিদ আস‘আদ মাদানী রহ., হযরত মাওলানা মারগুবুর রহমান রহ. ও হযরত মাওলানা সায়্যিদ আরশাদ মাদানী দা.বা.।
তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে বিজনুরে নিজ বাড়িতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। বিভিন্ন স্থানে তাঁর সুস্থতার জন্য দোআ হচ্ছিল, কিন্তু আল্লাাহ রাববুল আলামীনের ইচ্ছা ছিল ভিন্ন।
অবশেষে ১ লা মুর্হরম ১৪৩২ হিজরী মোতাবিক ৮ ডিসেম্বর ২০১০ ঈ. বুধবার সকাল সাড়ে দশটায় তিনি এই নশ্বর জগত থেকে বিদায় নেন। তিনি অন্তিম শয়ানে শায়িত হন দারুল উলূমের মাকবারায়ে কাসেমীতে। আলাহ তাঁর কবরকে নূর দ্বারা ভরপুর করে দিন।
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া, দারূল উলূম ডায়েরি ১৯২৯- নাসিরকারওয়া।