খতমে নবুয়ত ও কাদিয়ানী ফেতনা
মুফতী হাফীজুদ্দীন
উলামায়ে কেরাম বাতিলের ব্যাপারে সদা জাগ্রত ছিলেন। বাতিল যখনই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চেয়েছে তখনই তাঁরা কঠিন হস্তে তা দমন করেছেন। বিশেষ করে ফিদায়ে মিল্লাত হযরত মাওলানা সায়্যিদ আস‘আদ মাদানী রহ. স্বভাবগতভাবেই বাতিলের বিরুদ্ধে সদা সতর্ক এবং বজ্র কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন। তিনি ইংরেজদের সৃষ্ট কাদিয়ানী ধর্মমতের অপতৎপরতা তথা ইসলামে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টায় লিপ্ত দোসরদের বিষয়ে খুবই সোচ্চার ও সাবধান ছিলেন। কাদিয়ানী ধর্মমতের প্রবক্তা অভিশপ্ত মালাউন মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর জন্মস্থান ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশে। সে তার প্রাথমিক কাজ এখানে শুরু করলেও ৪৭-এর দেশভাগের পর তাদের বিদেশী প্রভুদের নির্দেশে তার অনুসারীরা পাকিস্তান চলে যায়। কিন্তু হযরত ফিদায়ে মিল্লাত রহ. এ বিষয়ে পূর্ব থেকেই ভবিষ্যৎবাণী উচ্চারণ করেছিলেন যে, মুসলিম দেশ পাকিস্তানে এরা রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষিত হতে পারে, কিন্তু তারা তাদের মিশনের জাল বিস্তার থেকে মোটেও ক্ষ্যন্ত হবে না। দেখা যাবে, পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত হয়ে এরা অপকর্মের জন্য পুনরায় ভারতকেই বেছে নেবে। হয়েছিলও তাই। প্রায় দশ হাজার শহীদের তাজা রক্তের বিনিময়ে ১৯৮৬ ঈ. সালে জেনারেল জিয়াউল হকের সময় এরা পাকিস্তানে অমুসলিম ঘোষিত হয়ে লেজ গুটিয়ে ভারতেই ফিরে আসে। প্রসঙ্গত বলতে হয় যে, রাবেতা আলমে ইসলামীসহ মধ্যপ্রাচ্যের সকল মুসলিম দেশেই কাদিয়ানীরা রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষিত হয়েছে।
কাদিয়ানী ফেতনার সূচনা ও ওলামায়ে কেরাম
১৮৮৮ ঈ. মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী তার ষড়যন্ত্রমূলক কাজের ঘোষণা দেয়। মানুষকে আকৃষ্ট করার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করে ১৮৮৮ ঈ. সালে ঘোষণা করে যে, ‘আমার হাতে বায়আত হতে তোমাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে’। তার এই ঘোষণার ফলে ২৩ মার্চ পাঞ্জাবের লুধিয়ান এলাকায় চল্লিশজন লোক তার হাতে বায়আত গ্রহণ করে। পর্যায়ক্রমে সে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কিছু দাবি করতে থাকে। এক পর্যায়ে তার ছেলে মির্যা মাহমুদ ঘোষণা করে, ‘যে ব্যক্তি কাদিয়ানী বিশ্বাসে বিশ্বাসী হয়ে তাঁর কাছে বায়আত গ্রহণ না করবে সে কাফের। ইসলামের গণ্ডি থেকে বের হয়ে যাবে। যদিও সে মাসীহে মাওউদের (ভন্ড কাদিয়ানীর) নামও না শুনে থাকুক’।
ভারতবর্ষ জুড়ে যখন ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনের বৃক্ষ পল্লবিত হচ্ছে। হযরত সায়্যিদ আহমদ শহীদ রহ.-এর জিহাদী আন্দোলন চলছে, সায়্যিদ জামালুদ্দীন আফগানীর ইসলামী ঐক্যের আন্দোলনে নবজাগরণ শুরু হয়েছে। এহেন পরিস্থিতিতে ইংরেজরা তাদের আস্থাভাজন অনুচর হিসাবে গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীকে বেছে নেয়। শুরু হলো ইংরেজদের দালালী। তাদের সহযোগিতায় কাদিয়ানী আন্দোলন শাখা-প্রশাখায় ছড়াতে থাকে।
১৯২৫ ঈ. সালে কাদিয়ানী এজেন্ট হয়ে আফগানিস্তানে তাদের ধর্মপ্রচারের অপরাধে আবদুল লতীফ কাদিয়ানী ও আবদুল হাকীম কাদিয়ানী নামের দু’জনকে আফগান সরকার মৃত্যুদ- কার্যকর করে। এটা কাদিয়ানী আন্দোলনের নেতাদের বিশাল মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে উলামায়ে দেওবন্দ এবং হিন্দুস্তানের বিচক্ষণ মুসলমানগণ এই ফেতনার স্বরূপ বুঝতে সক্ষম হন। তাই তারা কর্ম ময়দানে অবতরণ করেন।
১৩৩১ হিজরীতে ইমামে রব্বানী হযরত মাওলানা রশিদ আহমাদ গাঙ্গুহী রহ. এবং শায়খুল হিন্দ হযরত মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দী রহ. ফতোয়া জারি করেন। সে ফতোয়ায় তাঁরা কাদিয়ানীদের মুরতাদ, যিন্দিক ও কাফের বলে আখ্যায়িত করেন।
কাদিয়ানী ফেতনা প্রতিহতের জন্য এক জামাত উলামা সামনে এগিয়ে আসেন। আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী, মাওলানা মুহাম্মদ আলী মুঙ্গীরী, মাওলানা ইউসুফ বিনুুরী, মাওলানা আতাউল্লাহ শাহ বুখারী, মাওলানা আহমদ আলী লাহোরী, মাওলানা আবদুশ শাকুর ফারুকী, মুফতী মুহাম্মদ শফী দেওবন্দী, মাওলানা মুরতাজা হাসান চাঁদপুরী রহ.-সহ উলামাদের এক জামাত কাদিয়ানী ফেতনা মোকাবেলাকে নিজের জীবনের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে ছিলেন।
আন্তর্জাতিক মহলে কাদিয়ানী মুখোশ উন্মোচন
রাবেতা আলমে ইসলামীর আয়োজনে মক্কা মুর্কারমায় এক কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। ১৪ থেকে ১৮ রবিউল আওয়াল ১৩৯৪ হিজরী মুতাবিক ৬ থেকে ১০ এপ্রিল ১৯৭৪ ঈ. এই পাঁচ দিনের কনফারেন্সে ফিদায়ে মিল্লাত রহ. যোগদান করেন। ১৪০ টি রাষ্ট্র ও সরকারের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেছিলেন। আলোচ্য বিষয়ের মাঝে কাদিয়ানী ফেতনা বিষয়টিও ছিল।
এহেন অবস্থা অবলোকন করে পাকিস্তানের উচ্চপদস্থ কয়েকজন কাদিয়ানী সরকারী কর্মকর্তা রাবেতার কয়েকজন সদস্যকে প্রভাবিত করার হীন ষড়যন্ত্র চালিয়ে ছিল। তারা যেন কনফারেন্সে কাদিয়ানী বিষয়টি উত্থাপিত হলে কুফুরী দোষ বলে উক্ত ব্যাপারে ভেটু দেয় আর বিষয়টি সর্বসম্মত পাস না হয় বরং মতানৈক্য সম্পন্ন বিষয়ে রিপোর্ট হয়। তখন কাদিয়ানী ফেতনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠ, এবং তাহাফ্ফুজে খতমে নবুয়তের প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব মাওলানা মনযুর আহমদ চিন্নুটি বিষয়টি উপলব্ধি করে পেরেশান হয়ে গেলেন। করণীয় স্থীর করলেন যে, মক্কা মুর্কারমায় গিয়ে মাওলানা আস‘আদ মাদানীকে অবহিত করবেন। কারণ মাওলানা আস‘আদ মাদানী রহ. রাবেতার সদস্য এবং তাঁর পক্ষে এ মুহূর্তে বিষয়টি মুকাবিলা করা সম্ভব।
ফিদায়ে মিল্লাত রহ. বিষয়টি জানতে পেরে অত্যন্ত কৌশলে সকল সদস্যকে কাদিয়ানিদের বিষয়টি অবহিত করেন এবং সর্বসম্মতিক্রমে তাদের কাফের ঘোষিত হওয়ার ব্যাপারে সফল ভূমিকা রাখতে সক্ষম হন। এর ফলে ঐ সময়ে তাদের চক্রান্ত নস্যাৎ হয়ে যায়।
রাবেতা আলম কনফারেন্সে কাদিয়ানী পর্যালোচনা
উক্ত কনফারেন্সে যে সব পর্যালোচনা হয় সেগুলো নিম্নরূপ-
১. কাদিয়ানী বা আহমদিয়া জামাত এমন এক বিশৃংখলাকারী গোষ্ঠী যারা ইসলামের নাম ব্যবহার করে নিজেদের জঘণ্য ও নোংরা উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়ন করার অপচেষ্টায় লিপ্ত।
২. ইসলামী শিক্ষা ও আদর্শের বিরুদ্ধে তাদের ন্যাক্কারজনক পদক্ষেপগুলো হলো,
ক. মিথ্যা নবুয়তের দাবী খ. কুরআনের আয়াতের বিকৃতি সাধন গ. জিহাদের বিধানকে রহিতকরণ।
৩. কাদিয়ানী ধর্ম বৃটিশ সাম্রাজ্যের সৃষ্ট ও তাদের দ্বারাই লালিত। বৃটিশদের পৃষ্ঠপোষকতায় তারা সামনে অগ্রসর হচ্ছে। তারা উম্মতে মুসলিমার স্বার্থে আঘাত হানছে। সা¤্রাজ্যবাদী ইহুদীদের সাথে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করছে।
৪. কাদিয়ানী ধর্ম ইসলামের শত্রুদের থেকে সাহায্য নিয়ে ইসলামী শিক্ষা ও আকীদাকে রহিত করা ও বিকৃতি করার ক্ষেত্রে তাদের দোসরদের ভূমিকা পালন করছে। এ জন্য কাদিয়ানী ধর্ম যেসকল মাধ্যম ব্যবহার করছে তা হলো,
ক. ইসলামের শত্রুদের থেকে সহযোগিতা নিয়ে উপসনালয় নির্মাণ ও সেখানে কাদিয়ানীদের গোমরাহ আকীদা ও চেতনা শিক্ষা দিচ্ছে।
খ. স্কুল ও এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করে মানুষকে ইসলামবিরোধী তৎপরতার শিক্ষা দিচ্ছে।
গ. বিভিন্ন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ভাষায় কুরআনের বিকৃত অনুবাদ করে প্রচার করছে।
এ সকল হুমকি মুকাবেলা করার জন্য এ সম্মেলন সুপারিশ করছে যে,
কাদিয়ানীর ব্যাপারে রাবেতা আলমের সিদ্ধান্তবলী
১. তাদের কাফের হওয়ার ঘোষণা প্রকাশ্যে দিতে হবে এবং ইসলামের পবিত্র জায়গাসমূহে তাদের প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে।
২. তাদেরকে সামাজিকভাবে তালীমী দিক থেকে বয়কট করা হবে। তাদের সাথে বিবাহ-শাদী বর্জন এবং মুসলমানদের কবরস্থানে তাদের দাফন নিষিদ্ধ করা হবে। তাদের সাথে আচার-আচরণ কাফেরদের মতো হবে।
৩. সকল ইসলামী সরকারের কাছে আবেদন- তারা যেন নবুয়তের দাবিদার মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানীর অনুসারীদেরকে প্রতিহত করে এবং তাদেরকে অমুসলিম সংখ্যালঘু বলে চিহ্নিত করে ও ক্ষমতার কেন্দ্রে যেন তাদেরকে জায়গা না দেয়।
৪. সমস্ত ইসলামী সংগঠন এ বিষয়ে গুরুত্ব দেবে যে, কাদিয়ানী তৎপরতা যেন কেবল তাদের স্কুল, এতিমখানা ও নিজ প্রতিষ্ঠানে সীমাবদ্ধ থাকে।
৫. মুসলমানদেরকে তাদের ধ্বংসাত্মক কর্মকা- থেকে বাঁচানোর জন্য ইসলামী দুনিয়াকে তাদের বাস্তবতা ও রাজনৈতিক দুরভিসন্ধির ব্যাপারে সতর্ক করা।
৬. মুসলমানরা কাদিয়ানীদের সাথে কোনো প্রকার লেনদেন করবে না।
৭. পবিত্র কুরআনে তাদের বিকৃতিগুলো চিহ্নিত করে, তাদের অনুবাদের তালিকা তৈরি করে মানুষকে সে ব্যাপারে সজাগ করতে হবে ও তাদের প্রচার-প্রসারকে বন্ধ করতে হবে।
পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজ্যে কাদিয়ানীদের কাফের ঘোষণা
- ৭ জুলাই ১৯৩৫ ঈ. ভাওয়ালপুর জেলার ডিস্ট্রিক জাজ মুনশি মুহাম্মদ আকবর খান কাদিয়ানীদেরকে কাফের ও ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাওয়া একটি জামাত বলে সিদ্ধান্ত দেন।
- ২৫ মার্চ ১৯৫৪ ঈ. রাওয়ালপিন্ডি সিনিয়র সিভিল জাজ’ মিয়া মুহাম্মদ সেলিম কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম বলে সাব্যস্ত করে।
- ৩ জুন ১৯৫৫ ঈ. রাওয়ালপিন্ডি জেলার ডিস্ট্রিক জাজ কাদিয়ানীদেরকে কাফের ও ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাওয়া একটি জামাত বলে সিদ্ধান্ত দেন।
- ২২ মার্চ ১৯৬৯ ঈ. গিরিখা সিভিল জাজ জনাব শেখ মুহাম্মদ রফীক তার এক সিদ্ধান্তে কাদিয়ানীদেরকে কাফের ও ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাওয়া একটি জামাত বলে সিদ্ধান্ত দেন। চাই তা কাদিয়ানী গ্রুপ হোক বা লাহোরী।
- ১৯৭২ ঈ. ভাওয়ালপুরের কমিশনার জনাব মালিক আহমদ খান কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম ও উম্মত থেকে পৃথক এক সম্প্রদায় বলে ঘোষণা দেন।
- ২৮ এপ্রিল ১৯৭৩ ঈ. আজাদ কাশ্মির এ্যাসেম্বলী কাদিয়ানীদেরকে সংখ্যালঘু অমুসলিম বলে বিল পাশ করে।
পাকিস্তান জাতীয় পার্লামেন্টে কাদিয়ানীদের কাফের ঘোষণা
৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ ঈ. পাকিস্তান জাতীয় পার্লামেন্ট সর্বসম্মতিক্রমে কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম সংখ্যালঘু কাফের বলে সিদ্ধান্ত দেয়। একইভাবে আদালত, পার্লামেন্ট, সরকার সকলেই কাদিয়ানীদের ইসলামের নামে প্রতারণা বুঝতে পেরে তাদেরকে অমুসলিম ঘোষণা দেয়।
অতপর ২৬ এপ্রিল ১৯৮৪ ঈ. মুসলমানদের দাবির সামনে কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট কর্তৃক আরেকটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। যাতে হুকুম জারি করা হয় কাদিয়ানীরা ইসলামী কোনো প্রতীক ব্যবহার করতে পারবে না। নিজেদেরকে মুসলমান দাবি করতে পারবে না। নিজেদের ধর্মকে ইসলাম বলতে পারবে না। তাদের ধর্মের প্রচার-প্রসার করতে পারবে না। নিজ উপসনালয়কে মসজিদ বলতে পারবে না। তাদের উপসনাকে নামায বলতে পারবে না ইত্যাদি।
অতপর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের জারিকৃত কাদিয়ানী প্রতিরোধমূলক এই আইন লঙ্ঘনের সাজা তিন বছরের কারাদ- নির্ধারণ করা হয়।
এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে কাদিয়ানীরা ১৯৮৪ ঈ. সনের জুলাই মাসে আদালতে মামলা করে। মহামান্য আদালত প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক কর্তৃক প্রণীত অধ্যাদেশকে অক্ষুণ্য রাখে এবং ২৮ অক্টোবর ১৯৮৪ ঈ. কাদিয়ানীদের দায়ের করা আপিল খারেজ করে দেয়। পর্যায়ক্রমে কাদিয়ানীরা পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের দ্বারস্থ হয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞ বিচারম-লী বিষয়ের বাস্তবতা বুঝতে পেরে কাদিয়ানীদেরকে সংখ্যালঘু অমুসলিম বলে ঘোষণা করেছে।
দারুল উলূম দেওবন্দে ‘রদ্দে কাদিয়ানিয়্যত’ সম্মেলন
হযরত ফিদায়ে মিল্লাত রহ. কাদিয়ানিদের এ বিষয়ে পূর্ব থেকেই সজাগ ছিলেন। তিনি দারুল উলূম দেওবন্দের মজলিসে শুরার বৈঠকে বসে সকলের সম্মতিক্রমে তথায় আন্তর্জাতিকভাবে ‘রদ্দে কাদিয়ানিয়্যত’ শীর্ষক এক মহাসম্মেলনের আয়োজন করেন। ১৯৮৬ ঈ. সালে ২৯, ৩০, ৩১ অক্টোবর তিন দিনব্যাপী সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়। হযরত ফিদায়ে মিল্লাত রহ.-এর প্রচেষ্টায় রাবেতা আলমে ইসলামীর জেনারেল আবদুল্লাহ ওমর নাসীফ এতে অংশগ্রহণ করেন। এ ছাড়াও হিন্দুস্তানসহ লন্ডন, আফ্রিকা, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, দুবাই, আবুধাবী এবং সৌদি আরবের প্রতিনিধিগণ এই মহা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন।
এ মহা সম্মেলনে হযরত ফিদায়ে মিল্লাত রহ.-এর পরামর্শে ‘নিখিল ভারত তাহাফ্ফুজে খতমে নবুয়ত’ সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়। হযরত মাওলানা মারগুবুর রহমান রহ.কে সদর-সভাপতি, মুফতী সাঈদ আহমদ পালনপুরী রহ.কে জেনারেল সেক্রেটারী ও মাওলানা কারী সায়্যিদ ওসমান সাহেবকে সেক্রেটারী নির্বাচন করা হয়। মজলিসের সূচনা হয় হযরত মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী রহ.-এর মাধ্যমে ।
সমগ্র ভারতে এই সংগঠনের ব্যাপক সাড়া পড়ে। প্রতিটি মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় এর শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়। শুধু শাখাই নয়, হযরত ফিদায়ে মিল্লাত রহ. নিজেই দেশব্যাপী সফর করে সভা-সমাবেশ ও মাহফিল-সম্মেলনের মাধ্যমে কাদিয়ানীদের ঈমান বিধ্বংসী এই অপকর্মের বিষয়ে সবাইকে হুশিয়ার করেন। নবী প্রেমে উজ্জীবিত ঈমানী ফরীযার এ সবই ফিদায়ে মিল্লাত রহ.-এর একক তত্ত্বাবধান ও তদারকিতে সম্পন্ন হয়েছিল। এমনকি এ বিষয়ে তাঁর দূরদর্শী চিন্তা ও পরামর্শে দারুল উলূম দেওবন্দে খতমে নবুয়ত ডিপার্টমেন্ট তথা খতমে নবুয়ত বিভাগ চালু করা হয়।
সারা ভারতে তাহাফ্ফুজে খতমে নবুয়ত মাহফিল
ফিদায়ে মিল্লাত হযরত মাওলানা সায়্যিদ আস‘আদ মাদানী রহ.-এর অন্তরে হক ও সত্য লালনের যেই জযবা ও প্রেরণা সুপ্ত ছিল তা লিখে শেষ করা যাবে না, এরই ফলে তিনি কখনো বাতেলের সামনে মাথা নত করতেন না। তাদের সাথে লিয়াজু করার কোনো মনোভাবও তাঁর ছিল না। বাতিল প্রতিরোধে বিন্দু পরিমাণ গাফলত বা অবহেলা তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। তাই দেওবন্দে মহা সম্মেলন করেই ঘুমিয়ে পড়েননি, বরং যেখানেই গেছেন সে জায়গায় সাধারণ মুসলমান বিশেষ করে উলামাদেরকে এই ফেতনা সম্পর্কে অবহিত করেছেন। সারা হিন্দুস্তানে হযরত ফিদায়ে মিল্লাত রহ.-এর প্রচেষ্টায় তাহাফ্ফুজে খতমে নবুয়তের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং আলহামদুলিল্লাহ তা কামিয়াবও হয়। লখনৌ, কানপুর, ফিরোজাবাদ, রামপুর, হাপুড়, দিল্লী, করনাটক, বেঙ্গালোর, তামিলনাড়–, মাদ্রাজ, কেরালা, বিহার, ভাগলপুর, কলকাতা, আসাম, পাঞ্জাব, হারিয়ানা, পানিপথ, কাশ্মির, হায়দারাবাদ, মেওয়াতসহ সারা হিন্দুস্তানে এই কার্যক্রমের বিস্তার ঘটে।
রদ্দে কাদিয়ানিয়্যত তরবিয়তী ক্যাম্প
ফিদায়ে মিল্লাত হযরত মাওলানা সায়্যিদ আস‘আদ মাদানী রহ. জন সাধারণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সভা-সমাবেশ, সেমিনার, ইত্যাদির পাশাপাশি এ বিষয়ে অভিজ্ঞ মুনাযের-লেখক ও বক্তা গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন এলাকায় ট্রেনিং ক্যাম্পের ব্যবস্থা করেন।
১৯৮৮ সালে দারুল উলূম দেওবন্দে প্রথমবার দশদিনের ক্যাম্প করেন। তখন হযরত মুহতামিম সাহেবকে বলেন, এই বিষয়ে অভিজ্ঞ মাওলানা ইসমাঈল কাটকী প্রশিক্ষণ দিলে ভালো হতো, তার থেকে সময় নেন। তার দ্বারা এই বিষয়ে উলামা-তলাবাদের ফায়দা হবে। হযরত মুহতামিম সাহেব বলার আগেই হঠাৎ ফিদায়ে মিল্লাত হযরত মাওলানা সায়্যিদ আস‘আদ মাদানী রহ. অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে দেখতে আসেন মাওলানা ইসমাঈল কাটকী সাহেব। তখন ফিদায়ে মিল্লাত রহ. ঐ অবস্থায়ই কাটকী সাহেবকে তরবিয়তী ক্যাম্পে সময় দেওয়ার কথা বললে কাটকী সাহেব হযরতের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ২৪ ডিসেম্বর ১৯৮৮ ঈ. সালে দশ দিন তরবিয়তী ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ দেন।
এরপর ফিদায়ে মিল্লাত রহ.-এর নজর পড়ে মাওলানা মুহাম্মদ মনযুর আহমদ চিন্নুটির দিকে। তিনি কাদিয়ানী প্রতিরোধে অভিজ্ঞ মুবাল্লিগ ছিলেন। অনেক মুনাযারায় কাদিয়ানীদের পরাস্তকরণেও ছিলেন একজন সফল ব্যক্তিত্ব। হযরতের আহবানে মাওলানা মনযুর আহমদ চিন্নুটি সাহেব ১৯৯০ সালে পাকিস্তান থেকে দারুল উলূম দেওবন্দে তাশরিফ আনেন এবং দশদিনের তরবিয়্যাত ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ দান করেন। এটা ছিল দেওবন্দে দ্বিতীয় কর্মশালা। এভাবে পরবর্তীতে প্রায় প্রতিটি রাজ্যে একদিন, কোথাও দুইদিন, আবার কোথাও তিন দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের ব্যবস্থা করেন। তরবিয়তী ক্যাম্প যেখানে হয়েছিল, তার একটা সমীক্ষা নিচে দেয়া হলো,
- ১৯৯১ ঈ. সালে একদিনের তরবিয়তী ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয় ইউ. পি. ফিরোজাবাদে।
- ১৯৯২ ঈ. সালে পাঁচদিনের তরবিয়তী ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয় গৌহাটীতে, তিনদিনের জন্য মাদ্রাজে এবং এক দিনের জন্য লুওয়াই এ।
- ১৯৯৩ ঈ. সালে দুই দিনের তরবিয়তী ক্যাম্প মেইল ফ্লাম তামিলনাড়–, তিন দিনের ক্যাম্প ভাগলপুরে অনুষ্ঠিত হয়।
- ১৯৯৪ ঈ. সালে তিন দিনের তরবিয়তী ক্যাম্প বেঙ্গলোর (কর্নাটক) এ অনুষ্ঠিত হয়।
- ১৯৯৫ ঈ. সালে তিন দিনের তরবিয়তী ক্যাম্প কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয়।
- ১৯৯৬ ঈ. সালে চার দিনের তরবিয়তী ক্যাম্প নেপাল, দুই দিনের জন্য মুরশিদাবাদ, দুই দিনের জন্য বাঠাও, আজমীর এবং দুই দিনের জন্য ছোটা আনতা নদী (পশ্চিম বাঙলাতে) অনুষ্ঠিত হয়।
- ১৯৯৭ ঈ. সালে দুই দিনের তরবিয়তী ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয় চব্বিশ পরগানা (পশ্চিম বাঙ্গলা) এবং এক দিনের জন্য হাপুর (ইউ. পি)
- ২০০৩ ঈ. সালে অনুষ্ঠিত হয় তিন দিনের জন্য তরবিয়তী ক্যাম্প হারদুয়ি জেলার সিন্ধলায় এবং এরপর তিনদিনের জন্য সিতাপুর জেলার সিদ্ধলিতে।
কাদিয়ানী ফেতনা প্রতিরোধে বই-পুস্তক
কাদিয়ানীদের বিভ্রান্তিকর আকীদা সম্পর্কে মুসলমানদের সতর্ক করতে ৫০ টির মতো পুস্তিকা রচনা করা হয়। হ্যান্ডবিল, প্রসপেক্টাস ও প্রচারপত্রের মাধ্যমে এ ধরনের ঈমান বিধ্বস্ত কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা হয়। নি¤েœ কয়েকটি বইয়ের নাম উল্লেখ করা হলো।
১. মুবাহাসায়ে রাঙ্গুন, লেখক: ইমামে আহলে সুন্নত মাওলানা আবদুল শকুর ফারুকী।
২. কাদিয়ানীদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়, লেখক: হযরত মাওলানা কারী মুহাম্মদ ওসমান মনসুরপুরী দা.বা.।
৩. ইত্তেলায়ে রাহমানী বর আগলাতে কাদিয়ানী, লেখক: মাওলানা শাহ আলম গৌরকপুরী।
৪. মিরযায়িয়্যাত ও আদালতে ফায়সালা, লেখক: মাওলানা শাহ আলম গৌরকপুরী। (নেদায়ে শাহী ১৯৯ পৃ.)