সাত সকালে কুরআন তিলাওয়াতের ঐতিহ্য এখন বিলুপ্তির পথে!!
মুফতী মোস্তফা কামাল
একটা সময় ছিল যখন ফজর নামায আদায়ের পরেই শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ নারী পুরুষ পর্যন্ত সকলেই কুরআন পড়ায় মগ্ন হয়ে যেত। পুরুষেরা ঘরের বারান্দায়। মহিলারা ঘরের ভিতরে খিরকির পাশে। আর শিশু-কিশোররা রেহাল নিয়ে মসজিদ বা মাদরাসার মক্তবে।
পুরো এলাকা তখন কুরআন তিলাওয়াতে মুখরিত থাকতো। কেউ কোথাও সকালে বের হলে প্রতিটি ঘর থেকে কুরআনের আওয়াজ তার কানে ভেসে আসতো। এটা প্রায় সারা দেশের গ্রামবাংলার চিত্র।
কিন্তু আজ মুসলমানদের দ্বীনদারীর অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে? দিন দিন সাধারণ মুসলমানদের মাঝে কুরআনের পাঠকদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে! কুরআন তিলাওয়াতের প্রতি প্রেম আর ভালোবাসা ক্রমশই হ্রাস পাচ্ছে! অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে কুরআন তিলাওয়াত যেন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই না!! আফসোস! হায় আফসোস!!
কোথাও কোথাও শিশু কিশোররা মক্তবে গেলেও গ্রামবাংলার মুসলমানদের ঘরের বারান্দা আর অন্দর মহলে কুরআন পাঠের চিত্র এখন বিরল! পুরো এলাকা চষে বেড়ালেও কুরআন তিলাওয়াতের ঘর পাওয়া মুশকিল!
দেশে শিক্ষার হার বাড়ছে। শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। কথা ঠিক। কিন্তু কোন শিক্ষা? আফসোস হয়! কুরআন শিক্ষার হার দুঃখজনক ভাবে কমছে!
ডায়াবেটিস কন্ট্রোলে রাখতে সাত সকালে হাঁটাহাঁটিকে জরুরি মনে করলেও নামাজ আর কোরআন তিলাওয়াতকে মোটেই জরুরী মনে করছে না অনেকে।
অথচ কুরআনে কারিম মুসলমানদের জীবন নির্দেশিকা হওয়ার পাশাপাশি কুরআনের প্রতিটি অক্ষর তিলাওয়াতের মাঝে আল্লাহপাক সওয়াব
দান করেন। কুরআন তিলাওয়াতে পাঠকের হৃদয় প্রশান্ত হয়। জীবনে, রিজিকে ঘরে-বাহিরে বরকত এবং রহমত বর্ষিত হয়।
এই উপলব্ধি আর অনুভূতি থেকেই মুসলিম ঘরগুলোতে কুরআন পাঠ ও চর্চার রীতি চলে আসছে।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে জনসাধারণের মাঝে কুরআন পাঠের ঐতিহ্য বিলুপ্তির পথে। কুরআন তিলাওয়াত এবং চর্চার প্রতি সাধারণ মুসলমানের উদাসীনতা ও গাফিলতি ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা কখনো কাম্য ছিলো না।
কিয়ামতের ভয়াবহ অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলার অনুমতিতে রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতের জন্য সুপারিশ করবেন। কিন্তু যারা কুরআন ত্যাগ করেছে, কুরআনের হক আদায় করেনি, কিয়ামতের দিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে অভিযোগ দায়ের করবেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন,
﴿ وَقَالَ الرَّسُولُ يَا رَبِّ إِنَّ قَوْمِي اتَّخَذُوا هَـٰذَا الْقُرْآنَ مَهْجُورًا﴾ [الفرقان: ٣٠]
অর্থ: ‘আর রাসূল বলবেন,হে আমার রব! নিশ্চয় আমার কওম এ কুরআনকে পরিত্যাজ্য গণ্য করেছে’ [সূরা আল-ফুরকান-৩০]
এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি হাদিস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি এরশাদ করেছেন : «وَالْقُرْآنُ حُجَّةٌ لَكَ أَوْ عَلَيْكَ»
অর্থ: ‘কুরআন তোমার পক্ষে কিংবা বিপক্ষের দলীল।’ [সহীহ মুসলিম, হাদীস- ২২৩ ]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো ইরশাদ করেন,
«اَلصِّيَامُ وَالْقُرْآنُ يَشْفَعَانِ لِلْعَبْدِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ يَقُولُ الصِّيَامُ أَيْ رَبِّ مَنَعْتُهُ الطَّعَامَ وَالشَّهَوَاتِ بِالنَّهَارِ فَشَفِّعْنِي فِيهِ وَيَقُولُ الْقُرْآنُ مَنَعْتُهُ النَّوْمَ بِاللَّيْلِ فَشَفِّعْنِي فِيهِ قَالَ فَيُشَفَّعَانِ»
অর্থ: রোযা এবং কুরআন কিয়ামতের দিন মানুষের জন্য সুপারিশ করবে। রোযা বলবে, হে আমার রব! আমি দিনের বেলায় তাকে (রোযাদারকে) পানাহার ও যৌনতা থেকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল কর। অনুরূপভাবে কুরআন বলবে, হে আমার রব! আমাকে অধ্যয়নরত থাকায় রাতের ঘুম থেকে আমি তাকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল কর। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, অতঃপর উভয়ের সুপারিশই কবুল করা হবে। [মুসনাদে আহমদ, হাদীস- ৬৬২৬]
তাই আসুন সকাল-সন্ধ্যায় কোরআন পাঠে মনোনিবেশ করি। সাত সকালে কুরআন পাঠের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনি। কুরআনের আলোয় আলোকিত করি নিজের জীবন। জনসাধারণকে কোরআন চর্চা ও পাঠের প্রতি উদ্বুদ্ধ করি। কুরআন চর্চার পাঠশালা গড়ে তুলি। গ্রামে গ্রামে, মহল্লায় মহল্লায় এবং প্রতিটি মসজিদে কুরআনী মক্তব এবং বয়স্কদের কুরআন শিক্ষার কোর্স চালু করি। মসজিদগুলোতে সাপ্তাহিক বা মাসিক তাফসীরুল কুরআনের আয়োজন করি।
সর্বোপরি কুরআনকে আমি যদি বলতে পারি “কুরআন! তুমি তো আমার তাহলে কবরে ও কিয়ামতের মাঠে কোরআন আমাকে বলবে তুমিও তো আমার”।
আল্লাহ তা’আলা আমাদের সঠিক উপলব্ধির তৌফিক দান করুন। আমীন।।