ফকীহুল উম্মত, মুফতীয়ে আযম দারুল উলূম দেওবন্দ হযরত মুফতী মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী রহ.
নাম : মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী
জন্ম : ৮/৯ জুমাদাস সানি ১৩২৫ হিজরী মুতাবিক ১৯০৭ ঈ.
মৃত্যু : ২ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬ ঈ.
দাফন : ৮ মুর্হরম ১৪২৭ হিজরী মুতাবিক ২০০৬ ঈ. সকাল ৭ টা ২৫ মিনিট
জীবনকাল : ৮৮-৮৯ বছর
সমাধি : এলসবার্গ, দক্ষিণ আফ্রিকা
পরিচিতি-
নাম : মাহমুদ হাসান, পিতা : হামেদ হাসান। দাদা : মুহাম্মদ খলিল।
জন্ম : ৮/৯ জুমাদাস সানি ১৩২৫ হি. মুতাবিক ১৯০৭ ঈ. ভারতবর্ষের উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর জেলার গাঙ্গুহ থানায় জন্মগ্রহণ করেন।
প্রাথমিক শিক্ষা : হযরত শায়খুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দী রহ. তার বিসমিল্লাহ করান, যার ঘটনা মুফতী সাহেব রহ. এভাবে ব্যক্ত করেন যে, আমি গাঙ্গুহতে ছেলেদের সাথে খেলাধুলা করছিলাম, হঠাৎ আমার পিতা এসে আমার হাত ধরে আমাদের বাসা অভিমুখে নিয়ে যান, সেখানে গিয়ে দেখি কয়েকজন মানুষ দাড়িয়ে আছেন, তাদের মধ্যে একজন আমাকে কিছু কালিমা পড়ান, এখন অবশ্য সেসব শব্দগুলো আমার মনে নেই, তবে এতটুকু মনে আছে যে, আমি আস্তে আস্তে সে শব্দগুলো উচ্চারণ করছিলাম, এরপর তারা চলে যান, এটাই ছিল আমার বিসমিল্লাহ অনুষ্ঠান, আর সেসব কথাগুলো বলেছিলেন হযরত শায়খুল হিন্দ রহ.। সাথে ছিলেন হযরত আব্দুর রহিম রায়পুরী রহ.। হযরত শায়খুল হিন্দের মাল্টার জীবনের পরের ঘটনা। হযরত মুফতী সাহেব রহ. হযরত গাঙ্গুহী রহ.-এর মেয়ের হেফজ খানায় হাফেজ করিম বকশ রহ.-এর নিকট ১৭ পারা এবং তার ইন্তিকালের পর হাফেজ আবদুল করিম ইমাম ও খতিব জামে মসজিদ গাঙ্গুহ-এর নিকট সমাপ্ত করেন। অল্প বয়সেই তিনি কুরআন শরীফ হিফজ সমাপ্ত করেন। কুরআন হিফযের সময়েই তার মধ্যে উর্দূর প্রতি প্রবল আকর্ষণ সৃষ্টি হয়। নিজ প্রচেষ্টাতেই তিনি কিসসায়ে মাহেবানযান’ এবং ‘ওফাতনামা’ পড়ে ফেলেন। ফার্সী কিতাবসমূহ মাওলানা ফখরুদ্দীন সাহেবের নিকট এবং আরবী ভাষার প্রাথমিক কিতাবগুলো নিজ পিতা মাওলানা হামেদ হাসান রহ.-এর নিকট পড়েন। ১৬ বছর বয়সে ১৩৪১ হি. তিনি মাযাহেরুল উলূম মাদরাসায় ভর্তি হন এবং এখানেই তিনি দরসে নিযামীর সকল কিতাব অধ্যয়ন করেন। ১৩৪৭ হি. পর্যন্ত তিনি মাযাহেরুল উলূমে পড়েন। ১৩৪৮ হি. তিনি বিশ্ববিখ্যাত দারুল উলূম দেওবন্দে ভর্তি হন। এখানে তিনি আবু দাউদ শরীফ হযরত মিয়া আসগার হুসাইন দেওবন্দীর নিকট এবং বুখারী শরীফ শায়খুল ইসলাম মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী রহ.-এর নিকট সমাপ্ত করেন।
দেওবন্দে শিক্ষা করে তিনি পুনরায় মাযাহেরুল উলূমে ফিসে আসেন এবং আবু দাউদ শরীফ ও বুখারী শরীফ শায়খুল হাদীস শায়খ যাকারিয়া রহ.-এর নিকট পড়েন। সাহারানপুর মাদরাসাতেই তিনি কিরাত ও তাজবীদ শাস্ত্রে দক্ষতা অর্জন করেন এবং এ বিষয়ে উচ্চতর কিতাব পড়ে পরীক্ষায় অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন। এ সময় খুশি হয়ে জনাব হাজী ওয়াজীহুদ্দীন সাহেব রায়িছ মিরাট এর পক্ষ থেকে একটি দামী ঘড়ি উপহার দেয়া হয়।
বাল্যকাল থেকেই পড়াশুনার প্রতি ছিল তার বিশেষ আকর্ষণ। কিতাবের মুতালাআ বা অধ্যয়ন তার নেশায় পরিণত হয়েছিল। হযরত মুফতী সাহেব রহ. নিজ ছাত্রবেলার একটি ঘটনা বর্ণনা করে বলেন যে, আমরা এক রুমে তিনজন ছাত্র থাকতাম। এতে তিন জনই পরস্পরে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতাম যে, রাতের এক তৃতীয়াংশ অমুক ছাত্র জাগ্রত থাকবে এবং মুতালাআ করবে, ২য় তৃতীয়াংশে অন্য ছাত্র আর শেষাংশে অপর একজন জাগ্রত থাকবে। তবে আমি এ চালাকিটা করতাম যে, অন্য ভাইদের অংশেও মুতালাআ করতাম।
মাযাহিরুল উলূমে পড়া অবস্থায় সাহারানপুর থেকে গাঙ্গুহ প্রায় ২০ মাইল দূরে অবস্থিত। জুমার দিন ইশরাকের পর পদব্রেজে রওয়ানা হতাম এবং জুমার পূর্বেই গাঙ্গুহ পৌঁছে যেতাম।
হযরত মুফতী সাহেব রহ. শায়খুল হাদীস যাকারিয়া রহ.-এর হাতে বায়আত হন এবং তারই তত্ত্বাবধানে আধ্যাতিকতার খেলাফত লাভ করেন। ছাত্রবেলায় হযরত মুফতী সাহেব রহ. নিজেই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল কিতাবের তাকরার করাতেন। কিন্তু উস্তাদ অবস্থায় সর্বপ্রথম ‘মিযান’ তারপর ধীরে ধীরে উপরের কিতাব পড়াতে থাকেন এবং শেষ পর্যন্ত বুখারীও পড়ান। মাদরাসা মাযাহিরুল উলূমে দীর্ঘ বিশ বছর অবস্থান করেন এবং তাবলীগী কাজ ছাড়াও পরীক্ষার সময় ইন্তেজামাত ও খতমে বুখারী এন্তেজামাত ভালভাবে আঞ্জাম দিতেন। এছাড়াও আরো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও দ্বীনের খেদমত করেন। এরপর দারুল উলূম দেওবন্দের মুহতামিম কারী তায়্যিব সাহেব রহ.-এর বিশেষ অনুরোধে এবং তার শায়খ হযরত যাকারিয়া রহ.-এর নির্দেশে ১৩৮৫ হি. মুতাবিক ১৯৬৫ ঈ. দেওবন্দের ফতোয়া বিভাগের প্রধান মুফতী হিসেবে অত্যন্ত আস্থার সাথে এ দায়িত্ব আঞ্জাম দেন। তার সময়ে দারুল উলূমের ফতোয়া বিভাগের অসাধারণ উন্নতি ও প্রসিদ্ধি লাভ হয়। নিজ লিখিত বিশেষ ফতোয়াসমূহ ‘ফাতওয়ায়ে মাহমুদিয়া’ নামে ১৮ খন্ডে ছাপা হয় এবং বিশ্বের গ্রহণযোগ্য ফতোয়া সমুহের মধ্যে তা গণনা করা হয়। হযরত মুফতী সাহেব মুনাযের ও মুবাল্লেগ ছিলেন। পুরা জীবনে কোনো ফেরকার সাথে তিনি পরাজিত হননি। সব স্থানেই জয়লাভ করেছেন। এছাড়াও অনেক কিতাবের লেখক, হাজারো মুরিদ ও খলিফা আছে। দ্বীনে হানাফির এ মহান ব্যক্তিত্ব- ইলমের জাহাজ সাউথ আফ্রিকার মাটিতে চীর নিদ্রায় আরাম করছেন।
কুতুবে আলমের সন্ধানে : একদা হেরেম শরীফের ইমাম ও খতীব সাহেব স্বপ্নে নবী করিম সা.-কে দেখেন, খতীব সাহেব প্রিয় নবী সা.-কে জিজ্ঞেস করেন যে এ যুগের কুতুব কে? তখন হুজুর সা. বললেন, মাহমুদ হিন্দী। খতীব সাহেব অনেক চিন্তার পর চিনতে পারলেন না যে মাহমুদ হিন্দী কে? তখনকার আরবের বাদশাহর সহযোগিতা নিয়ে পুরা বিশ্বে খবর নিয়ে দেখছেন কিন্তু মাহমুদ হিন্দীকে বের করা গেল না। ভারতের বিখ্যাত আলেম হযরত মাওলানা সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ.-কে জিজ্ঞাসা করার পর তিনি বললেন আপনার স্বপ্নে দেখা মাহমুদ হিন্দী ভারতবর্ষের উত্তর প্রদেশের দারুল উলূম দেওবন্দে অবস্থান করছে। তখন হেরেম শরীফের ইমাম ও খতীব সৌদি বাদশাহর মাধ্যমে দেওবন্দ মাদরাসার প্রিন্সিপাল সাহেবকে বললেন, মাহমুদ হিন্দীকে হেরেম শরীফে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু দেওবন্দের প্রিন্সিপাল সাহেব সে মাহমুদ হিন্দী অর্থাৎ মুফতীয়ে আযম হযরত মাওলানা মুফতী মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী রহ. কে না দিয়ে বললেন, পুরা পৃথিবীর বিনিময় হলেও ‘মাহমুদ হিন্দীকে’ দেওয়া যাবে না। দারুল উলুম দেওবন্দে তার অনেক প্রয়োজন। আমাদের আকাবির ও আসলাফ এমনই ছিলেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে আকাবিরের পুরোপুরি অনুসরণ করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
আমার স্মৃতি : দারুল উলূম দেওবন্দের সদর মুফতী, মুফতীয়ে আজম হযরত মাওলানা মুফতী মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী রহ.। হাজারো আলেম-ওলামা, মুফতী, মুহাদ্দিস ও শায়খুল হাদীসের তিনি উস্তাদ। তাঁর ভক্ত মুরিদানের হিসাব নেই। ১৯৯৬ ঈ. সালের শুরুতে তিনি পবিত্র রমযান কাটাবেন বাংলাদেশে, মালিবাগ মাদরাসায়। এটা সারা বাংলাদেশের জন্য একটি পরম পাওয়া, বিশাল নেয়ামত। এতো বড় ব্যক্তি, যাকে এক ঘণ্টার জন্য পাওয়া ছিল সোনার হরিণ পাওয়া। তিনি সেখানে পুরো রমযান থাকবেন সেটা যে কতো বড় বিষয় তা আর লিখনীর মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
যাইহোক হযরত তখন বার্ধক্যতায় নুয়ে পড়েছেন। কথা অনেক কম বলেন। হুইল চেয়ারে চলা-ফেরা করেন। সারা বাংলার ওলামা-মাশায়েখ তার সোহবত লাভের জন্য মালিবাগ জামিয়ার মসজিদে উপস্থিত। তাঁরাও হযরতের সাথে এতেকাফ করবেন। ভারত-পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশের মাওলানা, মুফতী, মুহাদ্দিস এবং তাঁর ভক্ত মুরিদানরাও উপস্থিত হয়েছেন।
আমি অধম ছোট বাচ্চা, কেবল শরহে বেকায়া জামাত শেষ করলাম। সাহস পেলাম না সেই মুরুব্বীর কাফেলায় যোগ দিতে, তাদের সোহবতে রমযান কাটাতে। কিন্তু এক নজর দেখার সৌভাগ্য হাত ছাড়া করা কোনো মতেই ঠিক হবে না। তখন তার মজলিসে হাজির হয়েছিলাম। খুব আস্তে আস্তে কথা বলেন। শ্রোতারা চাতক পাখির ন্যায় কথাগুলো লুফে নিচ্ছিল। এভাবে দুটা মজলিসে তার কথা শুনার সুযোগ হয়েছিল।
বাংলাদেশে এতেকাফ করার পরের বছরই হযরত রহ. তাঁর পরম বন্ধু- আল্লাহ তাআলার সাক্ষাতে চলে যান। আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাতের উঁচু মাকাম দান করুন। আমীন।