সাহেবজাদা শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা শায়খ তালহা কান্ধলভী রহ.
নাম : তালহা কান্ধলভী
জন্ম : ২ জুমাদাল আউয়াল ১৩৯০ হিজরী মুতাবিক ২৮ মে ১৯৪১ ঈ.
মৃত্যু : ১০ জিলহজ্জ ১৪৪০ হিজরী মুতাবিক ১২ আগষ্ট ২০১৯ ঈ.
জীবনকাল : ৭৮ বছর
সমাধি : দাদা ইয়াহিয়া কান্ধলভীর পার্শে
পরিচিতি-
নাম : তালহা কান্ধলভী। পিতা : শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা যাকারিয়া কান্ধলভী রহ.। মাতা : সানিরা সালমা রহ.।
জন্ম : ২ জুমাদাল আউয়াল১৩৯০ হিজরী মুতাবিক ২৮ মে ১৯৪১ ঈ. জন্মগ্রহণ করেন।
প্রাথমিক শিক্ষা : হযরতের মা বছরের ছয় মাস সাহারানপুরে আর ছয় মাস দিল্লী নেযামুদ্দীনে থাকতেন। ছোট্টকালে বাচ্চা মা ছাড়া থাকতে পারে না, তাই হযরত তালহা রহ. এর প্রাইমারী শিক্ষা ছয় মাস দিল্লীতে আর ছয় মাস সাহারানপুরে হতো। ছোট্টকালে বিভিন্ন রোগব্যাধি ও শারিরিক দূর্বলতার কারণে হিফজ করতে বেশ সময় লেগে যায়। তবে কুরআনে কারীম হিফজকালীন পুরো সময়ই সাহারানপুরেই অবস্থান করেছিলেন। ২৯ শে ফেরুয়ারী ১৯৫৬ ই হিফজুল কুরআন সমাপ্ত করেন হিফজ সমাপ্ত করলে দিল্লী মসজিদে শাহীতে সর্বপ্রথম তারাবীহর নামায পড়ান। ৫ই ডিসেম্বর ১৯৫৬ ইং সালে সাহারানপুরে ফার্সীর শিক্ষার সূচনা হয়। এরপর ছয় বছর নেযামুদ্দীন দিল্লীতে আরবী শিক্ষা হাসেল করেন। কাসেমুল উলূম মারকায নেযামুদ্দীন দিল্লী থেকে ফারাগাত হাসেল করেন।
পিতা ও বংশীয় পরিচয়
হযরত মাওলানা তালহা কান্ধলভী রহ ছিলেন যুগ শ্রেষ্ঠ শায়খুল হাদীস আল্লামা যাকারিয়া রহ.-এর একমাত্র পুত্র সন্তান। তার পিতা হযরত শায়খ যাকারিয়া রহ. ছিলেন যুগের সর্বস্তরের ওলামায়ে কেরামের মারকায তথা কেন্দ্রস্থল। আর তালহা রহ.-এর দাদা হযরত মাওলানা ইয়াহইয়া কান্ধলভী রহ. ছিলেন কুতুবে আলম হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গংগুহী রহ.-এর সুযোগ্য ছাত্র এবং তার একান্ত খাদেম।
আর তালহা রহ. চাচাতো দাদা তথা হযরত মাওলানা ইয়াহইয়া কান্দলভী রহ. এর ভাই ছিলেন মুবাল্লিগে দ্বীন চলমান তাবলীগী জামাতের প্রতি হযরত মাওলানা ইলিয়াস রহ.।
পিতা হযরত শায়খ যাকারিয়া রহ. এর ব্যক্তিত্ব পরিচয় দেয়ার অপেক্ষা রাখে না। সারা বিশ্বে প্রচলিত ফাজায়েলে আমল কিতাবের তিনি লেখক। সারা বিশ্বে শায়খুল হাদীস বলতে তাকেই বুঝানো হয়ে থাকে। তিনি ছিলেন হযরত মাওলানা খলিল আহমদ সাহারানপুরী রহ. এর আস্থাভাজন খলিফা। কুতুবে আলম হযরত মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী রহ. এর অন্যতম খলিফা হযরত মাওলানা খলিল আহমদ সাহারানপুরী রহ. থেকেই শায়খ যাকারিয়া রহ. আধ্যাতিকতার সুধা আহরণ করেছিলেন।
শায়খ যাকারিয়া রহ.-এর পারিবারিক জীবন : হযরত মাওলানা খলিল আহমদ সাহারানপুরী রহ. অতি আনন্দচিত্তে কান্দলা নিবাসী মাওলানা রউফুল হাসান সাহেবের কন্যার সাথে আপন শিষ্য শায়খ যাকারিয়া কে প্রথম শুভ পরিণয়ে আবদ্ধ করেন। উক্ত বিবির গর্ভে পাঁচজন মেয়ে ও তিনজন ছেলে জন্মলাভের পর বিবি সাহেবা ইন্তেকাল করেন। পুত্র সন্তানেরাও ইন্তেকাল করেন। পাঁচ মেয়ের মধ্যে প্রথম মেয়েকে বিবাহ দেন মাওলানা ইউসুফ দেহলভীর সাথে। (মাওলানা হারুন এই মেয়ের গর্ভেই জন্ম নেয়) দ্বিতীয় কন্যাকে মাওলানা এনামুল হাসান (হযরতজী তাবলীগ জামাতের বিশ্ব আমীর) সাহেবের সাথে বিয়ে দেন। তার গর্ভে মাওলানা যুবায়ের জন্ম লাভ করে।
তৃতীয় কন্যাকে হাকিম ইলিয়াস সাহারানপুরীর সাথে বিয়ে দেন। তার গর্ভজাত সন্তান মাওলানা শাহেদ সাহেব।
চতুর্থ কন্যা বিয়ের পর পরেই ইন্তেকাল করেন। পঞ্চম কন্যা বিয়ে দেন মাওলানা ইউসুফ রহ.-এর সাথে। হযরত শায়খুল হাদীস রহ. এর প্রথমা স্ত্রীর ইন্তিকালের পর তিনি মাওলানা ইলিয়াস সাহেব রহ. এর (তাবলীগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা আমীর) মেয়ের সাথে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন। তার গর্ভে দুই কন্যা ও এক পুত্র সন্তান (মাওলানা তালহা কান্ধলভী রহ. জন্ম লাভ করে। প্রথম কন্যাকে বিবাহ দেন মাজাহিরুল উলূমের উস্তাদ মাওলানা আকিল সাহেবের সাথে। দ্বিতীয় কন্যার বিয়েও হয় একই মাদরাসার উস্তাদ মাওলানা সালমান সাহেবের সাথে। তার একমাত্র পুত্র সন্তান হযরত মাওলানা তালহা কান্ধলভী রহ.। তার জীবন নিয়েই আমাদের আলোচনা। তবে হযরত মাওলানা যাকারিয়া রহ. এর প্রথমা স্ত্রীর ঘরের তিন পুত্র সন্তান শৈশবেই দুনিয়া থেকে বিদায় নেন।
জীবনের মৌলিক মিশন : তাঁর জীবনের মৌলিক মিশন ছিল তিনটি। ১. তাআল্লুক মাআল্লাহ ও যিকরুল্লাহ। ২. তালীমে কুরআন ও মক্তব প্রতিষ্ঠা। ৩. দাওয়াত ও তাবলীগ।
বায়াত ও আধ্যাত্মিক সাধনা
হযরত মাওলানা তালহা রহ. নিজের শৈশবকালের কিসসা বর্ণনা করে বলে আমাদের লাইব্রেরী ‘কুতুবখানা ইয়াহইয়া’তে বসে এলাকার বাচ্চাদেরকে নিয়ে রুমাল হাতে দিয়ে খেলাচ্ছলে বায়আত করছিলাম। এর মাঝে হযরত মাওলানা সায়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদানী রহ. তাশরীফ আনেন, আর আমাদের এই চিত্র দেখে বললেন, ভাই আমাকেও তোমার বায়আত করিয়ে নাও। আমি বাচ্চা সূলভ ভাষায় বললাম, ঠিক আছে, রুমাল ধরে বায়আত হয়ে যাও। হযরত মাদানী রহ. তাই করলেন। তখন থেকে হযরত মাদানী আমাকে পীর সাহেব বলে ডাকতেন। এটা আমার এক ধরণের উপাধিতে পরিণত হয়ে যায়। ঘ.চ. হযরত আলী মিয়া নদভী রহ বলেন মাওলানা তালহা সাহেব পড়ালেখা শেষ করার পর হযরত মাওলানা আবদুল কাদের রায়পুরী রহ. এর হাতে বায়আত গ্রহণ করেন। হযরত রায়পুরীর ইন্তেকাল হলে আপন পিতা হযরত শায়খুল হাদীস রহ. এর হাতে বায়আত হয়ে যিকির ও শুগলে লিপ্ত হন। সুলুকের সবগুলো স্তর পার হলে হযরত শায়খ তাকে রবিউল আউয়াল মাসে ১৩৯১ হিজরীতে এজাজত ও খেলাফত প্রদান করেন।
শুরু থেকেই তার প্রতি হযরত মাওলানা আবদুল কাদের রায়পুরী রহ. এর নেক দৃষ্টি ছিল, তাছাড়া সে যুগের বড় বড় মাশায়েখদের আসা-যাওয়া ছিলো তাদের বাড়িতে। আর হযরত শায়খুল হাদীসের সাহেবজাদা হিসাবে সবাই তাকে পেয়ার করতেন। দুআ দিতেন।
হযরত মাওলানা তালহা রহ. নিজেই বলেন, মুহতারাম পিতা হযরত শায়খ যাকারিয়া রহ. যেহেতু যুগের মাশায়েখদের নেতৃত্বে ছিলেন, প্রায় সবাই আমাদের কাচা ঘরে আসা-যাওয়া করতেন। তাই আমার শৈশবকালেই তাদের সোহবত ও ¯েœহ পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল।
হযরত মাওলানা মুফতী সাঈদ আহমদ ওজারভী, শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা মাদানী, মাওলানা মুহাম্মদ ইউসুফ, মুফতী মাহমুদ গাঙ্গুহী এর মত ব্যক্তিত্ব এর খেদমতেই আমার শৈশবকাল অতিবাহিত হয়। তাদের কিছু ঘটনা আমার স্মৃতিপটে রয়েছে।
হাস্যজ্জ্বল চরিত্রমাধুরী!
নবী সা. সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলতেন। সাক্ষাত করতেন। ويلقي بوجه طلق ’ হযরত মাওলানা তালহা রহ. এর মাঝে এই গুণটি পরিপূর্ণভাবে পরিলক্ষিত হতো। ধণী গরিব সবার সাথেই হাসিমুখে কথা বলতেন। ছোট বড় সবার সাথে মহব্বত ও ভ্রাতৃত্বের আচরণ করতেন। তার দোস্ত ও দুশমন সবার সাথে আচরণ ছিলো এক ধরণের।
মেহমানদারী
তিনি বড় মেহমানদার ছিলেন। হযরত শায়খ যাকারিয়া রহ. এর দস্তরখানের প্রসিদ্ধি সারা হিন্দুস্তানে ছড়িয়ে ছিলো। হযরত পীর সাহেব তথা তালহা রহ.ও অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে সেই দস্তরখানের আমল ধরে রেখে ছিলেন। খাস, আম, জামায়াত বা একাকী আগমনকারী কেউ না খেয়ে যেতে পারতেন না। খাদেমদের প্রতি তাকিদ ছিলো মেহমানদের খেদমতে যাতে কেনো ত্রæটি না হয়। খাদেমদের থেকে কখনো কোনো ত্রæটি হলে রাগ করতেন। ধমকী দিতেন। সায়্যিদ সালমান হুসাইনী নদভী দা.বা. তার আরবী প্রবন্ধ ‘মুযকিকারাতী’ এর মাঝে লিখেন যে,আমি এমন উত্তম চরিত্র, ভদ্র মেহমানদার লোক দেখিনি।
অনৈসলামিক পোষাক ছিলো অপছন্দের
সারা দুনিয়া থেকে লোকজন তার সাথে সাক্ষাত করতে এবং দুআ নিতে আসতো। তাদের মাঝে বিভিন্ন ধরণের লোকও থাকতো। তাদের মাঝে অনৈসলামিক পোষাক দেখলে অথবা দাড়ি টুপি অনৈসলামিক দেখলে অনেক সময় রেগে যেতেন। ইসলাহ তথা শুদ্ধির জন্য নির্দেশ দিতেন। যদি ছোট দাড়ি অথবা দাড়ি ছাড়া লোক সাক্ষাতে আসতো,তাহলে মাঝে মধ্যে এত রাগ করতেন যে, লোকটি সাথে সাথে তওবা করে দাড়ি রাখার নিয়্যত করে ফেলতেন।
ব্যবসা ও উপার্জন
তিনি একজন আবেদ ইবাদতগুজার ব্যক্তি ছিলেন। সাদা সিধে, সরলমনা মানুষ ছিলেন। কিতাবাদি বেচাকেনা ছিলো তার উপার্জনের মাধ্যম। তিনি তার পিতা হযরত শায়খ যাকারিয়া রহ. এর রেখে যাওয়া, ‘ইয়াহইয়া কুতুবখানা’ কে ধরে রেখেছিলেন। পিতার লিখিত দুর্লব কিতাবাদী পূণঃমুদ্রণ করে ছিলেন।
মাজাহেরুল উলূম এর পৃষ্ঠপোষক
১৪০০ হিজরীতে মাজাহেরুল উলূম সাহারানপুরের শুরা সদস্য নির্বাচিত হন। কয়েক বছর এই মাদরাসার সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্বও পালন করেছিলেন। পিতা শায়খ যাকারিয়া রহ. এর ইন্তিকালের পর ১৪০২ হিজরীতে পিতার জায়গায় তাকে প্রধান পৃষ্ঠপোষক বানানো হয়। আজীবন তিনি এই দায়িত্ব পালন করে ছিলেন।
শেষ জীবন
দীর্ঘ অসুস্থতার কারণে তার মৃত্যুর ভুল সংবাদ ছড়িয়ে পরেছিলো। ২০১৮ ইং তার আহলিয়া মুহতারামা মিরাঠে ৬৮ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। হযরত মাওলানা সাদ কান্দলভী তার জানাযার ইমামতী করেন। কান্ধালায় তাকে দাফন করা হয়। জীবনের বিভিন্ন স্তর পার করে ১০ই জিলহজ্জ ১৪৪০ হিজরী মোতাবিক ১২ই আগষ্ট ২০১৯ ইং মিরাঠের আনন্দ হসপিটালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
আমার স্মৃতি
হযরত শায়খুল হাদীস রহ.-এর ব্যক্তিত্বের কথা শুনতে শুনতে অবচেতনভাবে তার প্রতি শ্রদ্ধা মহাব্বত, ভালবাসা অন্তরের মনিকোঠায় জায়গা করে নিয়েছিলো। কিন্তু তিনি তো দুনিয়াতে নেই, তাই তাঁর লিখিত কিতাবাদি পড়েই তাকে দেখার তৃপ্তি পেতাম। তার একমাত্র পুত্র সন্তান হযরত মাওলানা তালহা কান্ধলভী রহ.-এর কথাও শুনেছি অনেক।
আল্লাহর ফজলে ২০১০ ই সালে আমি স্বপরিবারে হজ্বের সফরে যাই, সাথে দুই পুত্র সন্তান মুহাম্মদ হুযায়ফা ও মুয়াজ। তাদের মাও সাথে ছিলো। হজ্বের আমল শেষ করে এবার আমরা মদীনা মুনাওয়ারায়। জান্নাতুল বাকীর দিকে আমাদের থাকার হোটেল। ফলে আবদুল আজীজ গেইট দিয়ে মসজিদে নববীতে আসা যাওয়া আমাদের জন্য সুবিধার ছিলো। ঘটনাক্রমে সে সময়ে হযরত মাওলানা তালহা রহ.ও মদীনায়। হযরতও আবদুল আজীজ গেইট দিয়ে আসা যাওয়া করেন। হুইল চেয়ারে করে আগন্তুক, যার পেছনে অনেক লোকের হুজুম দেখে আমি কাছে গেলাম, সালাম মুসাফাহ করলাম। পরিচয় নিয়ে জানতে পারলাম তিনি আর কেউ নয়, আমার প্রাণ প্রিয় ব্যক্তিত্ব হযরত মাওলানা তালহা সাহেব। নিজের সন্তানদেরকে পেশ করলাম দুআ নেয়ার জন্য। মুয়াজ তখন কিছুটা হাঁটতে পারে কথাও বলতে পারে অল্প অল্প। তার মাথায় ফু দেয়ার জন্য এগিলে দিলে হযরত হঠাৎ করেই ফু দিয়ে বললেন, ইহা ইয়ে জুরম হ্যায়। অর্থাৎ ফু দেয়া এ দেশের লোকদের ধারণায় অপরাধ।
দুই বাচ্চা নিয়ে আসা-যাওয়ার সময় হযরতের সাথে বার বার সাক্ষাৎ হয়েছে। তাই দেখলে মুসকি হাসি দিতেন। হযরতের কাছে বসতাম।
বাংলাদেশ সফরকালে তাঁর সাথে আমার একবার সাক্ষাত হয়েছিল। জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগে তিনি তাশরিফ এনেছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন, আমি বাংলাদেশে আসার উদ্দেশ্য হলো ঐসব এলাকা দেখা যেখানে শায়খুল ইসলাম হযরত মাদানী রহ. দীর্ঘদিন তিনি ইসলাহী ও দাওয়াতী মেহনত করেছিলেন। অর্থাৎ সিলেট এলাকা দেখতেই আমি বাংলাদেশ সফরে এসেছি।
মসজিদে নববীতেই তার সাথে আমার প্রথম ও শেষ সাক্ষাৎ। দুআ নিয়েছি একাধিকবার। আল্লাহ তাআলা তার মাকাম অনেক উঁচু করুন।