হযরত মাওলানা মালিক আবদুল হাফীজ মক্কী রহ.
নাম : আবদুল হাফীজ
জন্ম : ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে অবিভক্ত ভারতে পাঞ্জাবের অমৃতসরে এক কাশ্মিরী রাজ পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
মৃত্যু : ১৬ জানুয়ারী ২০১৭ ঈ. সোমবার
জীবনকাল : ৭১ বছর
সমাধি : জান্নাতুল বাকী
পরিচিতি-
নাম : আবদুল হাফীজ মক্কী। পিতা : মালিক আবদুল হক রহ.
জন্ম : তিনি অখণ্ড হিন্দুস্তান থাকাকালীন পাঞ্জাবের অমৃতসর শহরে ১৯৪৬ খৃস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।
হযরত শায়খ মক্কীর জীবন পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় জীবনের পরতে পরতে রয়েছে কুদরতের অসীম রহমতের বারিধারা। হযরতের জন্ম হয়েছিল একটি রাজ পরিবারে। হযরতের ঊর্ধ্বতন পূর্বপুরুষ ছিলেন রাজা আবদুস সালাম মালিক। কাশ্মিরের অন্তর্গত ইসলামাবাদের পার্শ্ববর্তী একটি এলাকার তিনি অধিপতি ছিলেন। হযরতের বাবা ছিলেন স্বনামধন্য ধনাঢ্য একজন ব্যবসায়ী। সৌদি আরবের প্রসিদ্ধ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মালিক ছিলেন তিনি। কিন্তু কুদরতের ফয়সালা ছিল অন্য কিছু। তাই হযরত রাজ-রাজত্ব, অর্থ-বৈভবে বিত্তবান হওয়ার পথ ছেড়ে দীনহীন জীবনের দিকে ধাবিত হলেন।
পারিবারিকভাবে ম‚লত তাঁরা কাশ্মিরের বাসিন্দা ছিলেন। তাঁর প‚র্বপুরুষ ‘আব্দুস সালাম মালিক’ কাশ্মিরের কুলিগ্রাম অঞ্চলের শাসক ছিলেন। তিনি ১৪০০ শতকের প্রসিদ্ধ স‚ফী-সাধক সায়্যিদ আলী আল হামদানি’র হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন।
দেশভাগের সময় শায়খ আবদুল হাফিজ মাক্কী রহ.-এর পরিবার হিজরত করে পাকিস্তানের ফয়সালাবাদে চলে আসেন। ফায়সালাবাদ থাকাবস্থায় তিনি তাঁর দাদির নিকট কুরআন শরীফ অধ্যয়ন শুরু করেন। তিনি ছিলেন মুসলিম বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ইসলামি ব্যক্তিত্ব, মুসলিম উম্মাহর অন্যতম আধ্যাত্মিক রাহবার, বিশ^ব্যাপী খতমে নবুওয়ত কার্যক্রমের অগ্রগামী সিপাহসালার, শায়খুল হাদিস যাকারিয়া রহ.-এর প্রিয়তম শিষ্য ও অন্যতম খলীফা।
মক্কা মুকাররমায় হিজরত
দেশবিভাগের ফলে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলার কারণে তাঁর পিতা ১৯৫৩ খৃস্টাব্দে পবিত্র মক্কা মুকাররমায় হিজরত করেন। ১৯৬০ খৃস্টাব্দে তাঁরা স্থায়ীভাবে সৌদি আরবে বসবাসের অনুমতি পান। তখন শায়খ আবদুল হাফীজ মক্কী রহ.-এর বয়স ছিল সাত বছর। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে তিনিও পবিত্র মক্কা নগরীতে হিজরত করেন।
প্রাথমিক শিক্ষা : মক্কা মুকাররামায় কারী আব্দুর রউফ রহ.-এর কাছে তিনি পুনরায় কুরআনে কারীম তাজভীদসহ অধ্যয়ন শুরু করেন। অতঃপর ১৯৫৪ খৃস্টাব্দে মক্কা মুকাররামার মাদরাসায়ে সাদিয়া’য় দ্বীনী ও সাধারণ শিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্যে ভর্তি হন। পবিত্র মক্কা নগরীর আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানেও মাওলানা আবদুল হাফিজ মক্কী পড়ালেখা করেন।
উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা-দীক্ষা
১৯৫৪ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তাঁর প্রাথমিক থেকে শুরু করে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পুরো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-দীক্ষা হেজাজের পবিত্র ভ‚মিতেই সম্পন্ন হয়েছিল। উচ্চ মাধ্যমিকে তার ফলাফল এত ভাল হয়েছিল যে সৌদী সরকার সরকারী খরচে তাকে ইউরোপ, আমেরিকায় উচ্চ শিক্ষার জন্য গমন করার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল, কিন্তু আসমানের ফয়সালা ছিল ভিন্ন। কুদরত সিদ্ধান্ত করে রেখেছিল অন্য কিছু। আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের চাপ ও অসন্তুষ্টি সত্তে¡ও হযরতের বাবা পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, আবদুল হাফিজকে আমেরিকা, ইউরোপ পড়াশোনার জন্য পাঠাব না, ওকে হিন্দুস্থান পাঠাবো, সেখানে সে আলেমদের জুতা সোজা করবে।
হিন্দুস্থানের বুযুর্গদের সোহবত
১৯৬৪ খৃস্টাব্দে মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্তির পর তাঁর মুহতারাম পিতা, পবিত্র মক্কা নগরীর তাবলীগ জামাতের অন্যতম জিম্মাদার ‘হাজি মালিক আবদুল হক’ রহ.-এর নির্দেশে তৎকালীন দাওয়াত ও তাবলীগের আমীর হযরতজী ইউসুফ রহ.-এর সাথে পুরো একবছর তাবলীগের সফর করেন। তাবলীগের সফরে থাকাকালীন দাওয়াত ও তাবলীগের তৃতীয় আমীর হযরত মাওলানা ইনামুল হাসান রহ.-এর সাথে তাঁর সুসম্পর্ক তৈরি হয়। একচিল্লা, দুইচিল্লা করে করে এক সাল শেষ করলেন। বাবাকে চিঠি লিখলেন, বাবা! আমার পড়াশোনার উদ্দেশ্যে ইউরোপ আমেরিকায় যাওয়ার ইচ্ছে নেই। যদি দীনের কাজের জন্য যাওয়ার সুযোগ হয়, তাহলে আল্লাহর অনুগ্রহ। এখন আমার পরবর্তী কর্মস‚চি কী? বাবা জবাবে জানালেন, যেখান থেকে তোমার হৃদয়ের এমন পরিবর্তন এসেছে এবার সেখান থেকেই তোমার পরবর্তী কর্মসূচী ঠিক করে নাও। ১৩৮৫ হিজরী মোতাবেক ১৯৬৫ খৃস্টাব্দে মাওলানা আবদুল হাফিজ মক্কী রহ. তাঁর পিতার অনুমতি ও হজরত ইনামুল হাসান রহ.-এর নির্দেশনায় শায়খুল হাদীস মাওলানা যাকারিয়া কান্ধলভী রহ.-এর হাতে বায়আত গ্রহণ করেন। তাসাওউফের কঠিন স্তরগুলো অতিক্রম করে ইজাযত ও খেলাফত লাভ করেন। অতঃপর মক্কা মুকাররামায় প্রত্যাবর্তন করে তাবলীগের মেহনতে জড়িয়ে পড়েন। পাশাপাশি তিনি দারসে নেযামির কিতাবাদি অধ্যয়ন শুরু করেন।
উচ্চশিক্ষা অর্জন
২ বছর পর ১৯৬৭ খৃস্টাব্দে তিনি ভারতের বিখ্যাত দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাজাহিরুল উল‚ম সাহারানপুরে আগমন করে ‘মাওক্বুফ আলাইহি’ (মিশকাতুল মাসাবিহ-জামাত) এ ভর্তি হন। কিছুদিন অধ্যয়নের পর তিনি পুনরায় মক্কা নগরীতে ফিরে গিয়ে দ্বীনী ইলম অর্জনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। পরবর্তী বছর তিনি পুনরায় মাজাহিরুল উল‚ম সাহারানপুরে দাওরায়ে হাদিসে ভর্তি হন। সেখানে শায়খুল হাদীস হযরত যাকারিয়া কান্দলভী রহ.-এর কাছে সহীহ বুখারী শরীফ অধ্যয়নের সৌভাগ্য অর্জিত হয়। তিনি মাযাহিরুল উল‚ম সাহারানপুরের বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন।
শায়খের অপরিসীম খেদমত : শায়খুল হাদীস রহ.-এর ইন্তেকালের (১৯৮২ খৃস্টাব্দ) প‚র্ব পর্যন্ত মাওলানা আবদুল হাফিজ মক্কী ব্যবসা-বাণিজ্য, দরস-তাদরীস, পরিবার-পরিজনের মোহ ত্যাগ করে স্বহস্তে শায়খের যাবতীয় খিদমতের দায়িত্ব আঞ্জাম দেন। হযরতের বাবা মালিক আবদুল হক ছিলেন আপাদমস্তক ধর্মানুরাগী, আলেম প্রেমিক। হযরত শায়খুল হাদীস যাকারিয়া রহ. এর সঙ্গে ছিল তার গভীর সম্পর্ক ও ঘনিষ্ঠতা। জীবন দিয়ে খেদমত করেছেন তিনি হযরত শায়খুল হাদীসের। হযরত তাঁর আপবীতিতে লিখেছেন সেইসব খেদমতের নজীর বিহীন চিত্র। বাবার এই রক্ত ছেলের মাঝেও সঞ্চারিত হয়েছিল। মক্কা মুকাররমায় হযরত যখনই যেতেন আবদুল হাফিজ মক্কীও বাবার মতো জান-প্রাণ দিয়ে খেদমত করতেন। তিনি নিজেকে সঁেপ দিলেন হযরতেরই হাতে। শুরু হল আরেক অসীম জগত পানে অভিযাত্রা।
রাজ ও ধনাঢ্য পরিবারের সেই অসাধারণ তরুণ এখন প্রবলবেগে ছুটে চলেছে মহান আল্লাহর নৈকট্যলাভের ঊর্ধ্বজগত পানে। হযরত শায়খের স্নেহমায়া ও সোহাগপ্রীতির প্রেমাকর্ষণে শেষ কয়েক বছর আর ছেড়ে যেতে পারেন নি কখনো। পুরো সময়ই শায়খের খেদমত ও সুহবতে কাটিয়ে ছিলেন। হযরত শায়খের ওফাতের পর মক্কা মুকাররমায় গিয়ে খানকাহি মামুলাত চালু করলেন। হারামাইনের কাছে বসে মানুষের আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর সাথে তাআল্লুক সৃষ্টির পথ দেখালেন। সৌদি আরবে প্রচলিত তাসাওউফ সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিও দ‚রীভ‚ত করলেন। সৌদি আরবেই সীমাবদ্ধ থাকেনি তাঁর জ্যোতির্ময়তা ও ন‚রানিয়্যাতের এ প্রবাহ। দেশে দেশে ছুটে গেলেন। আফ্রিকা, আমেরিকা, জাম্বিয়া, গাম্বিয়া, পাকিস্তান, ভারতসহ অনেক দেশে। হাজারো হাজারো ভক্ত অনুরক্ত হল। সেখানেই গেলেন মানুষের মাথার মুকুট হয়ে থাকলেন। এই খানকাহি দাওয়াতের কাজেই তো ছুটে গিয়েছিলেন আফ্রিকায় সেখান থেকে আর ফিরে এলেন না।
বায়আত ও ইজাযত
নিজ পিতা ও হযরত মাওলানা ইনআমুল হাসান রহ.-এর নির্দেশে হযরত মাওলানা শায়খ আবদুল হাফীজ মক্কী রহ. যুগের অন্যতম বুযুর্গ শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা শায়খ যাকারিয়া কান্ধলভী রহ.-এর হাতে বায়আত গ্রহণ করেন। হযরত মক্কী রহ. তাঁর শায়খের কাছে বায়আত হওয়ার পর সুহবতে থাকতে থাকতে মনো জগতে এক নতুন আবর্তন দেখা দিল। দীর্ঘ দিন সূলূকের লাইনে রিয়াজাত ও মুজাহাদার পর মাত্র ২০ বছর বয়সে ১৩৮৭ হিজরীর ২৭ রমযান ১৯৬৬ খৃস্টাব্দে তিনি শায়খুল হাদীস রহ. এর কাছ থেকে ইজাযতপ্রাপ্ত হন। মাওলানা যাকারিয়া কান্দলভী রহ. স্বহস্তে তাঁর মাথায় পাগড়ি পরিয়ে চার তরীক্বায় খিলাফত প্রদান করেন।
১৩৮৭ হিজরীর রমজানে এতেকাফে থাকাকালে এক রাতে হযরত ডেকে নিয়ে তাকে ইজাযতের ইমামা পরিয়ে দিলেন। তারপর থেকে জীবনের সবগুলো রমযানই হযরতের সাথে কাটিয়েছেন। হযরত কাছে বসিয়ে বসিয়ে মুরাকাবা ও তাসবীহের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
দরস-তাদরীস ও রচনাবলী
হযরত শায়েখের অনুমতিক্রমে মক্কা মুকাররমায় মাদরাসা সাওলাতিয়ায় মেশকাত শরীফের দরস প্রদান করতে শুরু করলেন। কিছুদিন অতিবাহিত হতে না হতেই শায়খের কিতাব “আওজাযুল মাসালিক” “বাযলুল মাজহুদ” ছাপানোর প্রয়োজনীয়তা সামনে আসে। শায়খের অনুমতিক্রমে হযরত মক্কী চলে গেলেন মিশরের কায়রোতে। কয়েক বছর সেখানে অবস্থান করে শায়খের কিতাব ছাপানোর কাজ সমাপ্ত করলেন। শায়খের অনুমতি নিয়ে তাঁর লিখিত কিতাব “শরীয়ত ও তরীকত কা তালাযুম” আরবীতে রূপান্তরিত করলেন। রিয়াজুস সালেহীন কিতাবটিও শায়খের কাছে দরস নিয়ে তার ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচনা করার অনুমতি নিলেন। শুরু হলো হযরত মক্কীর জীবনের নতুন অধ্যায়। হাদীসের খেদমতে ছুটে চললেন বিপুল গতিতে। রচনা করলেন ‘ইসতেজাবুদ দুআ বা’দাল ফারাইয’ এবং ‘মাকামুল ইমাম আবি হানিফা’ সহ আরও অনেক কিতাব। হাদীসের দরস দানের পাশাপাশি রচনা, সম্পাদনা, এবং হাদীসের নতুন নতুন কিতাব প্রকাশের ক্ষেত্রে এক বিস্ময়কর নজীর স্থাপন করলেন। ‘শরহু মুশকিলিল আসার’-এর মতো দুর্লভ দুর্লভ হাদিসের গ্রন্থ পৃথিবীর আনাচ-কানাচ থেকে অনুসন্ধান করে বের করলেন এবং ছাপিয়ে বিশ্বের আলেম সমাজের হাতে তুলে দিলেন। সর্বশেষ নিজ শায়খের কিতাব ‘লামিউদ দুরারি’ এর সাথে ‘আল আবওয়াবু ওয়াত তারাজিম’ এবং উর্দু তাকরীরাত একত্র করে আরবীতে ভাষান্তর করে আরও নানান উপকারী দিক সংযোজনসহ বুখারী শরীফের এক সর্বোৎকৃষ্ট ভাষ্যগ্রন্থ ‘কানযুল মুতাওয়ারি’ নামে ছেপে প্রকাশ করলেন। সত্যিই যা উলামায়ে দেওবন্দের এক অম‚ল্য কীর্তি হিসেবে সর্বমহলে স্বীকৃত ও সমাদৃত হল।
শায়খুল হাদীস যাকারিয়া রহ. জীবিত থাকাকালীন ‘আল মাদরাসাহ আল সাওলাতিয়্যাহ’ তে হাদিসের দরস প্রদান, দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে বিশ্বব্যাপী ভ্রমণ যাবতীয় কাজ তিনি শায়খ রহ.-এর দুআ ও নির্দেশনায় পরিচালনা করতেন। শায়খুল হাদীস রহ. পরামর্শে তিনি ‘আল মাকতাবা আল ইমদাদিয়্যাহ’ নামে পবিত্র মক্কা নগরীতে লাইব্রেরী ও ‘আল রাশীদ প্রিন্টিং’ নামে পবিত্র মদীনা নগরীতে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন।
শায়খ যাকারিয়া রহ.-এর ইন্তেকালের পর তাঁর কিতাবাদি আরবি ও উর্দু ভাষায় প্রকাশনার মহান দায়িত্বও তিনি আঞ্জাম দেন।
তাহাফ্ফুজে খতমে নবুওয়ত ও কাদিয়ানী সম্প্রদায়
হযরত মক্কী রহ. ছিলেন দীনের বহুমুখী খেদমত আঞ্জাম দানকারী এক বিরল ব্যক্তিত্ব। তাসাওউফ ও সুলুকের ময়দানে যেমন ছিলেন, আধ্যাত্মিকতা ও বিলায়েতের উঁচুস্তরের মুকুট পরিহিত এক রাজাধিরাজ, তেমনি হাদিসের খেদমত ও ইলম চর্চায় ছিলেন এক আগ্রগামী মহান ব্যক্তিত্ব। দাওয়াত ও তাবলীগের ময়দানেও তার জুড়ি ছিল না। তবে তাঁর স্বতন্ত্র ঐকান্তিকতা এবং বিশেষ স্পৃহা ছিল খতমে নবুওয়ত সংরক্ষণের প্রতি। কাদিয়ানী স¤প্রদায়ের ভয়ানক ফিতনা থেকে মুসলমানদের ঈমান হেফাজত এবং রাস‚ল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালাম- এর পবিত্র শানকে অভিশপ্ত মির্যা কাদিয়ানীর ছোবল থেকে হেফাজতের জন্য তিনি বিপুল প্রত্যাশা ও প্রবল প্রেরণা পোষণ করতেন।
হযরত মক্কী রহ. ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল খতমে নবুওয়ত মুভমেন্ট-এর কেন্দ্রীয় আমীর। বিভিন্ন দেশে এ শাখা রয়েছে। হযরত রহ. যে দেশে যেতেন সেখানে খতমে নবুওয়তের কাজের জন্য ব্যাকুল হয়ে লোক খুঁজতেন। বিশেষ করে বাংলাদেশের ব্যাপারে হযরতের মনোযোগ ও ব্যাকুলতা প্রবল হয়ে উঠেছিল। কতক আলেমকে হযরত খতমে নবুওয়তের কাজের জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন, উৎসাহিত করেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে খতমে নবুওয়তের সবচে উল্লেখযোগ্য ও স্মরণীয় ঘটনা ছিল ১৯৯৩ সালে মানিক মিয়া এভিনিউতে খতমে নবুওয়ত সম্মেলন। সেখানে লাখো লাখো নবী প্রেমিক মুসলিম জনতার ঢল নেমেছিল। আগমন করে ছিলেন দেশ-বিদেশের বিশ^খ্যাত মুসলিম ব্যক্তিবর্গ। এমনকি কা‘বা শরীফের ইমাম সাহেবও আগমন করেছিলেন যদিও তিনি সম্মেলনে অংশ নিতে পারেন নি। মৌলিকভাবে এ সম্মেলন ছিল হযরত মক্কী রহ.-এর পরিকল্পনা, উদ্যোগ এবং অনুপ্রেরণার ফসল। এখানেই শেষ নয় এই সম্মেলনের আর্থিক সহায়তায়ও হযরত মক্কী রহ.-এর বেনজীর পরিশ্রম ও প্রয়াস এক বিরল ইতিহাস হয়ে আছে।
বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক ও গবেষণাম‚লক দাওয়াতি প্রতিষ্ঠান “খতমে নবুওয়ত মারকায ঢাকা” হযরতেরই চিন্তা ও ছায়ার প্রতিফলন মাত্র। এভাবে দেশে দেশে খতমে নবুওয়ত সংরক্ষণের প্রয়াসে হযরত মক্কী রহ.-এর অনন্য আলোকিত একটি নাম।
শুধু খতমে নবুওয়ত সংরক্ষণ, দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনত, আধ্যাত্মিকতা ও দীনীজ্ঞানের প্রচার প্রসারেই কেবল নয়; বরং মুসলিম বিশে^ ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক চিন্তায়ও হযরত মক্কী ছিলেন এক সচেতন ব্যক্তিত্ব। রাজনৈতিক দ‚রদর্শিতা ও সচেতনতা ছিল তাঁর এক বিশেষ স্বাতন্ত্র্য। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষণে তাঁর বিচরণ ছিল অনেক ঊর্ধ্বে।
বহুমুখী দ্বীনি খিদমাত আঞ্জাম
দ্বীনি কাজ, দ্বীনি প্রতিষ্ঠান, সংস্থাও সংগঠনের আর্থিক সহযোগিতায় একটি উজ্জ্বল অধ্যায় হযরত মক্কী রহ.-এর জীবন। বিশে^র কতো জায়গায় কতো প্রতিষ্ঠান, মারকায ও ইদারাই না চালু হয়েছে এবং চলছে তাঁরই সহযোগিতায়। এই ক্ষুদ্র একটি বাংলাদেশের কথাই যদি বলি, এখানেও হযরতের আর্থিক সহযোগিতার এক বিরাট ফিরিস্তি। সেই সুদ‚র নোয়াখালিতেও একটি দীনি প্রতিষ্ঠান চলছে তাঁরই সহযোগিতায়। খতমে নবুওয়তের অসংখ্য কাজ সম্পন্ন হয়েছে তাঁরই আর্থিক আনুক‚ল্যে। বাংলাদেশের স্বনামধন্য একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানেরও ফান্ড গঠন করে দিয়েছিলেন হযরত রহ.। আরও একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানে তাঁরই বিরাট সহযোগিতা রয়েছে। আর্থিক সহযেগিতার অভিযোগে বিশে^র দুটো দেশ তার ভিসা বন্ধ করে রেখেছিল। আর্থিক সহযোগিতায় তিনি একটি অন্যন্য উপমা। তারুণ্যে তাঁরই শায়খ শায়খুল হাদিস রহ. তাকে এ বলে মৃদু শাসনও করেছিলেন, তুমি কতজনের মন যোগাবে, সব মানুষের দায়িত্ব ও বোঝা তোমার নিজের কাঁধে কেন উঠিয়ে নিতে হবে। কিন্তু বার্ধক্যে পৌঁছেও তিনি তা ছাড়তে পারেন নি। তাঁর কাছে আবদার করে কেউ নিরাশ হয়নি। নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে করে আহলে খায়রের কাছে নিয়ে যেতেন এবং আর্থিক ফান্ড গঠনের চেষ্টা করতেন। মুসলিম বিশ্বের একজন হিতাকাক্সক্ষী অভিভাবকের জিম্মাদারী তিনি নিজের কাঁধে স্বেচ্ছার উঠিয়ে নিয়েছিলেন।
দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনত
হযরত যাকারিয়া রহ.- খেলাফত দেওয়ার পরই হযরতকে তিন চিল্লার জন্য আমরিকা পাঠিয়েছিলেন। তখন আমেরিকার বিভিন্ন রাষ্ট্র সানফ্যান্সিসকো, থ্যাইল্যন্ড, ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে তাবলীগি সফর করেছেন।
এভাবে আল্লাহ তাআলা নিজ কুদরতে হযরতকে তাবলীগ জামাতের সর্বব্যাপী দীনি কাজের চলমান বাহনে উঠিয়ে দিলেন। দেশ থেকে দেশান্তরে ছুটে গেলেন দাওয়াত নিয়ে। মক্কা মুকাররমায় তাবলীগে জামাতের জিম্মাদারও ছিলেন তিনি। হযরত প্রায় প্রতি বছর আগমন করতেন টঙ্গির বিশ্ব ইজতিমায়।
আখলাক ও উত্তম চরিত্র
হযরত মক্কী রহ. এর জীবনের সবচেয়ে তাৎপর্যময় অধ্যায় তাঁর চরিত্র মাধুরিমা। তাঁর বিভাময় ন‚রে ঝলমল উদ্ভাসিত চেহারাটাই ছিল তাঁর উত্তম গুণাবলীর প্রতিচ্ছবি। কী সরল সুন্দর হাসি! কী অসীম দিগন্তের মতো বিস্তৃত তার বক্ষ! কী মধুময় ও মার্জিত ছিল তাঁর জবান!
আলেম ও নায়েবে নবীদেরকে দেখলেই টান দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরতেন। দ্বীনের জন্য তিনি দলমত নির্বিশেষে সর্বমহলে পদচারণা করতেন। কোনো দল বা ব্যক্তিকে অবজ্ঞা করতেন না বরং সঠিক রাহনুমায়ী করার চেষ্টা করতেন।
মক্কায় হযরতের খানকাহ হল বিশে^র নানা দেশের আলেম উলামা ও দীনদার মানুষের নিরাপদ আশ্রয়। সবধরনের খাবার সরবরাহ করা হয় যে কোনো মেহমানের সম্মানার্থে।
হজ্বের মৌসুমে বহুলোকের আশ্রয় এই খানকাহ। মানুষের আবদার রক্ষা করতে গিয়ে নানাবিধ শরীরিক কষ্টও সইতে হতো অনেক সময়।
হযরতের প্রসিদ্ধ কয়েকজন খলীফা
তার খলীফাদের মাঝে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হচ্ছেন
১. হাফিজ প্যাটেল রহ. (ব্রিটেন)
২. হযরত মাওলানা ইব্রাহীম আদম (সাউথ আফ্রিকা)
৩. মাওলানা জুনাইদ হাশিম (সাউথ আফ্রিকা)
৪. মাওলানা আসআদ মাহমুদ (মক্কা মুকাররমা)
৫. মাওলানা মাসুদ আজহার (পাকিস্তান)
৬. মাওলানা ইলিয়াস ঘুম্মান (পাকিস্তান)
৭. মাওলানা মুহাম্মাদ ইয়াক্বুব (ভারত)।
বাংলাদেশে তার ২৮ জন খলীফা রয়েছেন।
ইন্তেকাল
১৬ জানুয়ারি ২০১৭ সোমবার সাউথ আফ্রিকায় সফরকালীন হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ইন্তেকাল করেন। ইন্নালিলাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন! খোদার কী অসীম করুণা তাকে ঘিরে রেখেছিল! মসজিদে নববীতে হলো তাঁর জানাযা। আর শায়িত হলেন রাওযায়ে আতহারের কাছে একদম কাছে! জান্নাতুল বাকীতে, যেখানে শুয়ে আছেন অসংখ্য সাহবায়ে কেরাম, এবং তাঁরই প্রেমাষ্পদ, মনিব হযরত শায়খুল হাদীস রহ. এবং তাঁরও শায়খ হযরত খলীল আহমদ সাহারানপুরীসহ অনেক অনেক আকাবীর।
আমার স্মৃতি : হযরত রহ.-এর সাথে আমার দেখা ও কাছে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল দুইবার। ১৪৩১ হিজরী মুতাবিক ২০০৯ সালে হযরত হাজীপাড়া ইকরা ঝিল মসজিদে পবিত্র রমজান মাসে এতেকাফ করেছিলেন। হযরতের ঢাকার এই এতেকাফ ছিল তাসাওউফ জগতের বিশাল জাগরণীর মতো। সে সময় তাঁর সোহবতে তাঁর কাছে বসার সুযোগ আমার হয়েছিল। আরবদের অভ্যাস অনুযায়ী হযরত রহ. লোকদের সাথে সালাম মুসাফাহা এবং কপালে চুমো খাওয়ার আমল করতেন। সে সময় আমাকেও তিনি পেয়ারের সাথে ঝরিয়ে ধরে দুআ দিয়েছিলেন।
দ্বিতীয় বার সাক্ষাত হয় মদিনা মুনাওয়ারায়। ২০১০ ঈ. সালে হজের সফরের পর মদীনা শরীফের মসজিদে নববীতে তাঁর সাথে আমার সাক্ষাত হয়েছিল। নবিজী সা.-এর রওজায় সালাম বলে বের হয়ে দেখি মাশায়খদের এক জামাত বসে আমল করছেন। তাঁদের পাশে আমিও বসে পড়লাম। আমার সাথে ছিল আমার ¯েœহাস্পদ দুই সন্তান- হুযায়ফা ও মুআয। তাদের জন্য হযরত রহ.-এর থেকে দুআ নিয়েছিলাম। হযরত রহ. তাদের জন্য হাসিমুখে দুআ করেছিলেন।